বিশ্ব জুড়ে বাংলা সাহিত্যের সম্ভার

বিশ্ব জুড়ে বাংলা সাহিত্যের সম্ভার

শূন্যতা / এম.এন.এস তুর্কী


শূন্যতা

সকালের সূর্যটা আজ কেন জানি নতুন সাজে সেজে প্রকৃতিকে বিভিন্ন রঙ-ঢঙে নৃত্য করে মোহিত করছে গোটা পরিবেশ। এ আনন্দের মাঝে বিমর্ষের চিত্র একে বসে আছে তন্ময়। কারণ,তার বাবার সাথে আজ সকালে বাহিরে যাওয়া হয়নি তার। তাই,মুখ গোমড়া করে ঘরের কোণে বসে অঝরে কাঁদছে সেই কখন থেকে। তার মা অনন্যা থেকে থেকে বকাও দিচ্ছে তাকে। 
কিন্তু বাবা হিমালয় সেই বকার মাঝে প্রাচীর হয়ে দাঁড়িয়ে বলল,তুমি কি আমার ছেলেকে একটুও সহ্য করতে পারো না। আমি খেয়াল করে দেখেছি,যখনই তুমি সুযোগ পাও তখনই তুমি তাকে বকাঝকা কর। কেন,বলতো? বাহ! বাহ! ভালই বলছো। আমি কিছু বললে বেশি বকাঝকা করা হয়। আর তুমি যখন কর, তখন কিছু হয়না। আমি ওকে বকি! কখন দেখলে যে,আমি ওকে বকাঝকা করি? তা কর কেন,শুধু আমার শাসনটাই তোমার চোখে পড়ে। 
মা-বাবার এমন কান্ড দেখে তন্ময় একবারে নিশ্চুপ। এখন সে নীরব হয়ে বাবা-মার ঝগড়া দেখছে আর হাসছে। তার বয়স মাত্র ৩০ মাস। এতটুকু ছেলের দুষ্টুমি চোখে পড়ার মত। ছেলের এমন কান্ড দেখে অনন্যা ও হিমালয় হেসে কুটিকুটি হয়ে গেল। যেই ওর মা আবারও চোখ রাঙিয়ে তাকে ধরতে গেল,সেই এক দৌঁড়ে বাবার কোলে ঝাপ দিয়ে উঠে বসে পড়ল। কোলে উঠে দাঁত বের করে দিয়ে হি,হি করে হাসতে লাগল। 
দেখছো,দেখছো তোমার ছেলে কেমন দুষ্টু হয়েছে। হবে না,দেখতে হবে না ছেলেটি কার? ও,তাহলে তুমি বলতে চাচ্ছো ছেলেটি শুধু তোমার। অনন্যা এবার আর একটুও দেরি না করে হিমালয়ের কাছে গিয়ে তাকে নিয়ে কাড়াকাড়ি শুরু করে দিল। কিন্তু দেখা গেল সে বাবা-মায়ের এ কাড়াকাড়িতে সুঁড়সুঁড়ি অনুভব করে খট্খট্ করে হাসতে লাগল। এই তুই যে আমার কোলে আসলি না,কিন্তু কাল থেকে কে তোকে কোলে নিয়ে বাহিরে যাবে? কাল তো তোর বাবা চলে যাবে। কথাটি সে বুঝলো,কি বুঝলো না সেটা বুঝা গেল না। তবে এতটুকু স্পষ্ঠ বুঝা যাচ্ছে,কথাটা শুনার সাথে সাথে মুখটা তার কেমন কালো হয়ে গেল। আচ্ছা তোমার কি এসব কথা এখন না বললে হত না? আহা! আমি কি বুঝেছি নাকি,যে তোমার এতটুকু ছেলে হয়েও কথাটা বুঝবে। 
তবে,বাস্তবতা হল এই যে,আর কিছু দিন পরে একটা “বীমা কোম্পানীর” চাকরির উদ্দেশ্য হিমালয়কে ছেড়ে যেতে হবে নিজ শহর ফেলে অনেক দূরে। চলে যেতে হবে অন্য একটি জেলাতে আর সেই জেলাটির নাম হল শরীয়তপুর। শরীয়তপুরের শহরটি বাংলাদেশের অন্যান্য জেলা শহর থেকে একটু ব্যতিক্রম। শহরটি নীরবতার পতাকা তুলে বাংলাদেশের বুকে দাঁড়িয়ে আছে দেশের প্রায় মধ্যে ভূমিতে। দেখতে দেখতে আমার যাওয়ার প্রহর ঘনিয়ে এলো। স্ত্রী ও অন্যান্যদের চোখে-মুখে বিষাদের কালো ছায়াও স্পষ্ঠ হয়ে ফুটে উঠতে লাগল। অবুঝ তন্ময় ফ্যাল,ফ্যাল করে তার পিতার দিকে তাকিয়ে থাকল। সে অবুঝ হলেও বুঝতে পারছে তার আব্বু বাহিরে কোথাও যাচ্ছে। কিন্তু সেই যাওয়া যে ক্ষণিকের নয়,সেটা সে বুঝতে পারছে না। তাই,আব্বুর শার্ট-প্যান্ট পরা দেখে সেও ব্যাতি-ব্যস্থ হয়ে উঠল বাহিরে যাওয়ার জন্য। তাই,সে বায়না ধরল তার আব্বুর মত তাকে নতুন কাপড়-চোপড় পরিয়ে দিতে হবে। যখন দেখল,তার মা নিজ জায়গা থেকে উঠছে না,তখন সে নিজেই একটা জামা বের করে এনে তার আব্বুর কাছে ধরল,আব্বু জামা,জামা। মানে জামাটি তাকে পরিয়ে দাও। আমি তন্ময়ের এ আকুতি দেখে নীরবে ভেঙ্গে যেতে লাগলাম হৃদয়ের গহীন ভান্ডার থেকে। কিন্তু আমি নিজেকে কোন রকম সংবরণ করে দু‘হাত দিয়ে তাকে কোলে জড়িয়ে ধরলাম। বাবা আমি কোথাও যাচ্ছি না। এই একটু বাহিরে যাব আর আসবো। এর মধ্যে তুমি তোমার আম্মুর সাথে খেলা করতে লাগো। আর ফিরে আসার সময় তোমার জন্য আমি চিপস নিয়ে আসবো। তন্ময়ের মুখে আর কোন কথা নাই। নিশ্চুপ,অপলক চোখে বাবাকে একবার ভালো করে দেখে নিল এবং সে নিশ্চিত তার বাবা কখনও মিথ্যা কথা বলে না। বাবা যখন বলেছে,তখন সে এক্ষুণিই ফিরে আসবে আর সাথে করে নিয়ে আসবে চিপস। হঠাৎ,কান্নাকাটি রেখে মুখে এক ঝলক হাসি দিয়ে তার কোলে চুপ করে বসে রইল। অনন্যা তন্ময়ের দিকে হাত বাড়িয়ে দিল তার কোলে যাওয়ার জন্য। কিন্তু না,সে তার বাবার কোলে থাকতে চাই আরোও। আব্বু,তুমি এখন তোমার মার কোলে যাও। আর কোন কথা নাই মূহুর্তের মধ্যে অভিমান নিয়ে তার বাবার কোল ছাড়ল। তবে,বাবার হাতে থাকা বড়,বড় ব্যাগ দুটির রহস্য সে বুঝতে পারছে না এখনও। বাবাতো যখন বাহিরে যায়,তখন তো কোনদিন এত বড় বড় ব্যাগ নিয়ে বের হতে দেখিনি। ছোট শিশুর চোখে কৌতুহল আর কৌতুহল! এ আজ অন্য রূপে কোন বাবাকে দেখছে! তবুও কোন কথা নেই। যখন আমি বাড়ির বাহিরের দিকে পা রাখলাম,তখন স্পষ্ঠ দেখতে পেলাম অনন্যার চোখের কোণে শিশির বিন্দু,বিন্দু অশ্রু জল টুপটাপ করে ঝরে পড়ছে। আর সে থেকে থেকে নিজ হাত দিয়ে চোখের পানি মুছছে। আমি জানি,এখন যদি আমি একটু আবেগময়ি হয়ে উঠি তাহলে স্ত্রী,পুত্র ও নিজ মায়ের অশ্রুর বন্যা বয়ে যাবে এখানে। তাই,নিজেকে সংযত রেখে সামনের দিকে পথ চলতে শুরু করলাম। হঠাৎ,কি মনে হল আমি একবার পিছন ফিরে তাকিয়ে দেখি তারা সবাই মলিন মুখে দাঁড়িয়ে আছে গেটের পাশে তখনও। সাথে তন্ময়ও কিছু বুঝা,কিছু না বুঝার চোখে তাকিয়ে ছিল আমার দিকে। এ এক অদ্ভুত দৃর্শ্য! না আর না ওদের থেকে চোখ ফিরিয়ে নিয়ে আমি নিজ গন্তব্যর দিকে হাঁটা শুরু করলাম।

হিমালয় প্রথম এই অপরিচিত,অজানা শহরে পা রেখে কেমন বেমানান মনে হতে লাগল নিজেকে। শরীয়তপুর শহরটির তেমন কোন চাকচিক্য নাই। আছে শহর ও গ্রামের দুটি অংশের মিলনে গড়া। তবে,গ্রামের পরিমাণটা বেশি হবে। চারিদিকে পাখির কুহুকুহু গান। কিচিরমিচির শব্দে মুখরিত করে রেখেছে পুরা পরিবেশটাকে। আমি এখানে আসা মাত্রই মোবাইলের মাধ্যমে খবর নিয়ে জানতে পারলাম তন্ময় ও অনন্যা ভাল আছে। তবে,চলে আসার পর নাকি তন্ময় তিন থেকে চার ঘন্টা যাবৎ আব্বু,আব্বু করে ঘরটি মাতোয়ারা করে রেখেছিল। 
তার আম্মুকে স্পষ্ঠ ও অস্পষ্ঠ মিশ্রিত গলায় বলেছিল,আম্মু আব্বু কখন আসবো? যখন সে দেখল,তার আব্বু আর আসলো না চিপস নিয়ে,তখন সে উদাস হয়ে বাধো,বাধো গলায় তার আম্মুর কাছে জিজ্ঞাসা করল,আব্বু আসিনি? আব্বু ঢাকায়? অর্থ্যাৎ,সে যখন কোন দূরত্বকে বুঝায়,তখন ‘ঢাকা’ শহর দিয়ে পরিমাপ করে। প্রথম,প্রথম তার মা কথাটা এড়িয়ে গেলেও পরক্ষণে আর এড়াতে পারিনি। পরবর্তীতে,তাকে বাধ্য হয়ে বলতে হয়েছিল ঢাকায়। তারপর সেই যে সে বাবার বিষয়ে চুপ হল। আর এখনও পর্যন্ত বাবার বিষয়ে বিন্দুমাত্র কোন প্রশ্ন করিনি। এতটুকু ছেলের অভিমানের ক্ষমতা সত্যই চোখে পড়ার মত! 

এখানে এসেছি প্রায় পনর দিন হয়ে গেল। ভোরে ঘুম থেকে উঠে আমি অনন্যার কাছে ফোন দিলাম। কি ব্যাপার,তোমাদের খবর কি? তোমরা দু‘জনে এখন কি করছো? কি আর করবো,এত সকালে? হাতে তেমন কাজ-কর্ম নাই শুয়ে শুয়ে তোমার ছেলেকে গল্প শুনাচ্ছি। তাহলে আমিও তোমার গল্প শুনতে চাই। কেন,তুমি কি বাচ্চা নাকি? বলতে পার এই মূহুর্তে আমি বাচ্চা। শোন,এত সকালে তোমার বাচ্চা হয়ে কাজ নাই। যেমনটি যুবক আছো,তেমনটি থাকো। হঠাৎ,তন্ময় বলে উঠল,আমি যুব.....। আমি যুব......। অনন্যা ছেলের এমন কান্ড দেখে হেসে বিছানাতে গড়াগড়ি খেতে লাগল। কি ব্যাপার,কি হয়েছে তোমার? আর বলোনা,তোমার ছেলে বলছে আমি যুব......। আমি যুব.....। মানে সে যুবক। দেখতে হবে না,ছেলেটি কার। আচ্ছা শোন,তুমি ওর কাছে মোবাইলটা দাও তো একবার। আমি ওর সাথে কথা বলতে চাই। এই নাও কথা বল। তন্ময় মুখ ঘুরিয়ে অন্য দিকে তাকিয়ে থাকল। তন্ময় বাবা,তোমার আব্বুর সাথে কথা বল। এবার সে স্পষ্ঠ বলল,না,না। 
কেন,আব্বুর সাথে কথা বল। সে মাথা ঝাঁকিয়ে আবারও অসম্মতি জানাল। তারপর থেকে আর কোন কথা নেই তার মুখে। ওপাশ থেকে অনন্যা অনেকক্ষণ ধরে চেষ্টা করছে তন্ময় যেন তার বাবার সাথে কথা বলে। কিন্তু কিছুতেই সে ওর বাবার সাথে কথা বলল না। এক পর্যায়ে মোবাইলটি হাতে নিয়ে সে ছুঁড়ে ফেলে দিল মেঝেতে। মেঝের উপর মোবাইলটি পড়ার সাথে সাথে ধড়ম করে শব্দ হল,কিন্তু কিছু হল না মোবাইলের। 
অনন্যা মেঝে থেকে মোবাইলটি উঠিয়ে বলল,তোমার ছেলের কান্ড দেখলে। কথা বলবে না বলে মোবাইলটি মেঝেতে ফেলে দিল। এরপর তন্ময় বায়না ধরল সে দুধ খাবে। তারপর সে মায়ের দুধ খেতে শুরু করল চুক্চুক্ করে। তোমার ছেলের খবর এখানে এ পর্যন্ত শেষ। সে এখন আর তোমার সাথে কথা বলবে না। এবার বল তোমার খবর কি? 
আমার খবর শুনতে চাও। আছি এক রকম! বস্তুতঃ এখানকার পরিবেশটা খুবই নীরব। এ শহরে কোন ব্যস্থতা নেই। শুনেছি শরীয়তপুরের অধিকাংশ লোক বিদেশে থাকে। তাও আবার বেশির ভাগ লোক থাকে ইতালিতে। এজন্য,বলা যায় জায়গাটা অর্থনৈতিকভাবে খুব সমৃদ্ধশালী না হলেও অনেকটা ভাল। আর অফিসের কাজ বলতেও তেমন একটা নাই। কিছু পেন্ডিং কাজ আছে,তবে ঐগুলো তাড়াতাড়ি শেষ হয়ে যাবে। তবে,অভাবের মধ্যে যেটা,সেটা হচ্ছে তোমাদেরকে কাছে না পাওয়া। 
তোমার যেমন কষ্ট হচ্ছে আমাদের ছাড়া থাকতে,তেমনি আমাদের ও কষ্ট হয় তোমাকে ছাড়া থাকতে। কিন্তু কিছুই করার নাই। পরিস্থিতি এখন আমাদের এখানে দাঁড় করিয়েছে। হ্যাঁ,তুমি ঠিকই বলেছো। দেখি,ছয় মাস না গেলেতো আর প্রভিশন প্রিয়িওয়ার্ড শেষ হচ্ছে না। প্রভিশন প্রিয়িওয়ার্ড শেষ না হওয়া পর্যন্ত ট্রান্সফারের কথা বলাও যাবে না। তারপর ট্রান্সফার হলে তো তোমাকে দেখতে পাব,তন্ময়কে দেখতে পাব। এজন্য তোমাদের আরোও কিছুটা দিন অপেক্ষা করতে হবে। তারপর সব কষ্টের পালা শেষ হবে। আচ্ছা অনন্যা এখন মোবাইলটা রাখি। ওদিকে আমার হাতে কিছু কাজ জমে আছে। ছুটির দিনে আবার কিসের কাজ? আছে,আছে ওসব তুমি বুঝবে না। আচ্ছা,এবার মোবাইলটি রাখি বলে অমনি আমি মোবাইলের সংযোগটি কেটে দিলাম। 

আমার  রুম মেড এর নাম রাজকুমার। সবাই তাকে দাদা বলে ডাকে। কারণ,সে ধর্মীয় মতে সনাতন ধর্মে বিশ্বাসী। এখানে অবশ্য মেসের অন্যান্য সদস্যদের সাথে পাঠকদের একটু পরিচয় করিয়ে দেওয়া আবশ্যক। মেস মেম্বর আমি ধরে মোট পাঁচজন রাজকুমার,সোহেল,জাকির,সুমন ও আমি । আমি বাদে সবাই মার্কেটিং চাকরি করে। রাজকুমার ও আমি প্রায় সম বয়সি। আর বাকি তিন জন প্রায় একই বয়সি। 
অনন্যার সাথে কথা শেষে হতে না হতে রাজকুমার দাদা জিজ্ঞাসা করল,কি ভাই মনে হল ভাবির সাথে কথা বললেন? জিঁ ভাই, আপনি ঠিকই ধরেছেন। তো কি কথা বললেন? কেন,আমার তো মনে হয় আপনি সব কিছুই শুনেছেন,তাহলে আবার জিজ্ঞাসা করার দরকার কি? হুম,আপনি ঠিকই বলেছেন। তবে,মনের সব কথা কি শোনা যায়। কিছু কিছু কথা আছে না যা,হৃদয়ের সাথে হৃদয়ের আদান-প্রদান হয়। আমার মুখে কোন কথা নাই। ভাই মনে হল,আমার উপর রেগে গেলেন? না দাদা,এতে রাগ করার কি আছে? রাগ করবেন না ভাই। আসলে,আমার তো আর মনের মানুষ বলতে কেউ নেই। তাই,এসব ব্যাপারে আমার আবার ভাই অত্যাধিক উৎসুক। ওহ! তো দাদা এত বয়স হয়ে গেল,এখনও বিয়ে-সাদি করছেন না কেন? কি আর বিয়ে করবো? মেয়েদের যেই ধরতে যাই,সেই যেন হাতের মুঠোর ভিতর থেকে ষোইল মাছের মত ফসকে যায়। বলে একটু দাঁত বের করে হাসল। হেসে হেসে আবার নিজেই বলল,ভাই এ হাসি সুখের হাসি নয়,কষ্টের! তো দাদা ষোইল মাছ কি ধরা অত সহজ! ষোইল মাছ যদি এমনিতে ধরতে না পারেন,তাহলে তাকে ছাই দিয়ে ধরুন। দেখবেন,ঠিকই মুঠোর ভিতর ধরা পড়ে গেছে। তখন দেখবেন,বাঁছাধন ষোইল হাতের ভিতর মোড়ামোড়ি করছে। কিন্তু বেরিয়ে যাওয়ার উপায় নাই। ভাই,সেই চেষ্টাও করিনি বলছেন? করেছি। তাতেও কোন লাভ হয়নি। আমি তো জীবনে কম চেষ্টা করলাম না,কিন্তু ভাই কোন কিছুতে কোন কাজ হল না। যদি ভাই আপনি একটু চেষ্টা করতেন,তাহলে মনে হয় আমার জীবনের ট্রাফিক জ্যামটি ছেড়ে যেত। আমিই! কিভাবে করবো? তাছাড়া,আপনি তো জাতিতে হিন্দ্ ুআপনাদের তো আবার কাষ্ট প্রবলেম আছে। তাছাড়া আরোও কত কিছু! তারপর নিশ্চয় আপনার একটা সাদা চামড়াওয়ালা মেয়ে চাই। এত কিছুর চাহিদা আমি মেটাতে পারবো না দাদা! কারণ,আমি হল মুসলমান। সাধারণতঃ আমার স্ব-জাতির সাথে আমার পরিচয় বেশি আছে। তারপরও যখন বলছেন,তখন দেখি আপনার জন্য চেষ্টা করে। পাশাপাশি আপনিও চেষ্টা করুন। ভাই,একটা কথা বলবো,কিছু মনে করবেন নাতো? না,না সমস্যা নাই বলুন। বলছিলাম,ভাবির নিশ্চয় অনেক হিন্দু বান্ধবী আছে। তাদের মাঝ থেকে যদি একটু কষ্ট করে খুঁজে দেখেন,তাহলে আমার দৃঢ় বিশ্বাস,সন্ধান একটা হবেই,হবে। আচ্ছা দাদা আপনি চিন্তা করবেন না,দেখি,আপনার জন্য কি করা যায়। সোহেল ও জাকির দাঁত বের করে হাসছে। হঠাৎ,সোহেল বলে উঠল,ভাই আমরা তো অনেকদিন ধরে চেষ্টা-তদবির করলাম,কিন্তু পারলাম না। এবার আপনি একটু চেষ্টা করে দেখেন,দাদার কোন একটা গতি করা যায় কিনা। আর ওদিকে নতুন আগত রুমমেট সুমনও সে ওদের কথায় সায় দিল। তবে,দাদা যখন ওদের দিকে কড়া দৃষ্টিতে তাকাল,তখন সবাই এক সাথে চুপ হয়ে যে যার কাজে মনোবিশন করল। 
ভাই,আপনি কিছু মনে করবেন না। ছেলেগুলি দিন,দিন এত ফাজিল হয়ে গিয়েছে যে,কিছু না বলতে বলতে ওরা গাছের মাথায় উঠে গিয়েছে। যাক,আজ তো আবার শুক্রবার কি খাবেন বলেন? তবে ভাই,যা খাওয়ার খাবেন,আমার কোন আপত্তি নাই। তবে,গরুর মাংস বাদে। বোঝেন তো,হাজার হলেও  গরু হল আমাদের দেবতা! আমি বেঁচে থাকতে এ দেবতাকে অসম্মান করতে দেব না। এতে যত বাঁধাই আসুক না কেন। তবে,ভাই আপনি গরুর দুধ খেতে পারেন। মায়ের আর্শিবাদীত দুধ পান করলে বুকটা আমার শীতল হয়ে যায়। আমি দাদার কথা শুনে,নিজেকে কিছুটা সামলিয়ে নিলাম। দাদা আমি কিন্তু গরু অপেক্ষা ছাগলের দুধ বেশি পছন্দ করি। এতে নাকি গরুর চেয়ে বেশি ভিটামিন? কে বলেছে ভাই? এসব মিথ্যা কথা। আপনারা এসব কেন বিশ্বাস করেন। আপনারা না শিক্ষিত লোক? শিক্ষিত লোকে সব সময় বুঝে-শুনে একটা সিদ্ধান্তে পৌঁছায়। কি দাদা ঠিক বলছি না? বটেই,বটেই! 
আচ্ছা ভাই আপনি বলুন তো অতটুকু একটা পুঁচকে ছাগলের কি বা ক্ষমতা আছে! সারাক্ষণ শুধু ম্যা,ম্যা করে চিল্লায়। কানটা একবারে ঝালাপালা করে ফেলে। আর একবার খেয়াল করে দেখুন গরুর বিষয়টা ওর ডাক শুনলে প্রাণটা আমার ভরে যায়। কি মধুর ডাক! আর তাছাড়া ওর শারীরিক যে গঠন,তাতে ওর দুধটা আসে কোথা থেকে। দেখবেন দাদা ব্যাটা ফাঁক পেলেই এর ক্ষেতে ওর ক্ষেতে ঢুকে গাছ-পালা যা আছে সব সাবাড় করে ফেলে। তারপর মালিক আসলে দেয় ছুঁট। আচ্ছা বলুন তো ভাই,চুরি-চাট্টামি করে কিবা ওর গায়ে দুধ হয়! আর গরুর দিকে তাকান তার প্রত্যেকটি জিনিসই কার্যকর। আর খায়ও নিয়মিত খল্,ভুট্টা,ঘাস ভাল ভাল খাবার। আমি আর থাকতে না পেরে রাজকুমার দাদার দিকে হাত উঁচু করে বললাম,দাদা আপনার কথা সবই ঠিক আছে। এবার যদি কিছু না মনে করেন তাহলে আমি একটু উঠতাম। কেন,এখন আবার কোথায় যাবেন? না মানে,নিজের কিছু ময়লা জামা-কাপড় ছিল ধুয়ে দিতে হবে। আরে ভাই,জীবনে কাপড়-চোপড় ধুয়াটাই বড় মনে করলেন,এই দাদার কথার কোন কি মূল্য নেই আপনার কাছে? কে বলল,আমার কাছে আপনার কথার কোন মূল্য নেই? তাহলে ভাই উঠতে চাইছেন যে! আর একটু বসুন। একটু মনের সুখ-দুঃখের কথা বলি,এতে মনটা আমার ভাল লাগবে। বোঝেন তো,মেসে সব পোলাপান মানুষ,ওদের সাথে সব কথা বলে মজা পায় না। তাই,আপনার সাথে একটু বেশি কথা বলি,বুঝলেন দাদা? তারপর দাদা কিছুক্ষণ চুপ থেকে কি মনে করে বলল,যান দাদা এখন। যখন আপনি ব্যস্থ মানুষ,সেহেতু আপনাকে আটকানো যাবে না। তবে,রাতে কিন্তু আমার সাথে আপনার সময় দেওয়া লাগবে। শুধু সময় না,ন্যাশনাল ব্রিজ তাসও খেলতে হবে। দাদা তো ন্যাশনাল ব্রিজ পারেন? তাই,না? পারতাম তো,এখন মনে হয় ভাল করে খেলতে পারবো না। আরে দাদা পারবেন,পারবেন। আপনি পারবেন না,এটা কি হয়? আপনার মত মানুষকে একবার দেখিয়ে দিলে গড়গড় করে সব কিছু মনে পড়বে। আপনি না একটা হিরো! হিরোকে নতুন করে পরিক্ষা করার কিছু নেই। দাদা এ ঘর থেকে হাঁক ছেড়ে বলল,এই সোহেল রাতে কিন্তু খিচুড়ি খেতে হবে। ঠিক আছে দাদা,এসব নিয়ে আপনার কোন চিন্তা করতে হবে না। সোহেল যদিও এ মেসের ম্যানেজার তবুও দাদার হুকুমে সব কিছু চলে এখানে।

আজ শুক্রবার হওয়াতে দিনটা কেমন অলসভাবে কাটছে। কারণ,এ শহরে নতুন হওয়াতে কারো সাথে তেমনে একটা পরিচয় নেই আমার। তাই,চার তলা মেসের ভিতর থেকে দিগন্তে যত দূর চোখ যায়,সেসব দেখা ছাড়া আর কোন কাজ নেই। দক্ষিণের জানালা খোলার সাথে সাথে চোখে পড়ল,একদল যুবক ক্রিকেট খেলছে। সম্ভবতঃ ছুটির দিন বলে তারা খেলতে এসেছে। প্রচন্ড বৈশাখীর তীব্র রোদ উপেক্ষা করে তারা খেলে চলেছে। এমনই সময় পিছন থেকে সোহেল ডাক দিল। ভাই যদি কিছু না মনে করেন,তাহলে আমাদের সাথে ক্রিকেট খেলতে চলেন। না,না তোমারা যাও। তাছাড়া,আমার কি আর রোদে পুড়ে খেলার বয়স আছে? কি বলেন ভাই,আপনার চেয়েও বয়স্ক লোক খেলতে আসে ওখানে। চলেন,আমাদের সাথে। গেলে সবকিছু দেখতে পাবেন। ঠিক আছে আজ তোমরা যাও,আগামিতে অবশ্যই খেলতে যাব তোমাদের সাথে। না মানে বলছিলাম কি,আজ আমাদের মেস বনাম কোর্টের কর্মচারিদের সাথে খেলা ছিল। এখন সমস্যা হচ্ছে মেসে খেলোয়াড় সংকট। এখান ওদের কাছ থেকে খেলোয়াড় ধার করে নিয়ে খেলতে হচ্ছে আমাকে। এসব কথা যখন হচ্ছিল,দাদা সব কিছু শুনতে পেয়ে পাশের রুম থেকে হাঁক ছাড়ল,এই তোমাদের যখন উনি বলছে যাবে না,তখন অত জোর করছো কেন? তোমরা যাও এখন। ওরা আর কথা না বলে বেরিয়ে গেল খেলার উদ্দেশ্য। চলে যাওয়ার পর কেমন জানি একটা নিঃসঙ্গতা আমাকে পেয়ে বসল। যাই,একটু আশে-পাশে কোথা থেকে ঘুরে আসি। দাদা,এখানে কোথাও কি কোন নদী-খাল বিল আছে নাকি? কেন,ভাই? না,এমনি জিজ্ঞাসা করলাম। আছে শুনেছি। কিন্তু কোনদিন যাওয়া হয়নি। বোঝেন তো মার্কেটিং চাকরি করি। এসব করে ঘুরে দেখার সময় কোথায়? তাহলে দাদা,আপনি থাকেন আমি বাহির থেকে একটু ঘুরে আসি। কিন্তু ভাই বাহিরে তো প্রচন্ড রোদ। অসুবিধা নাই। এই যাবো আর আসবো। যদি আপনার হাতে কোন কাজ না থাকে তাহলে,আমার সাথে চলেন। না,না ভাই আপনি যান। কখন আবার অফিস থেকে ডাক দিয়ে বসে তার কোন ঠিক আছে। আজ না শুক্রবার? তাতে কি,মার্কেটিং চাকরির কাজের কোন স্টেশন নাই। ওহ! 
আমি মেসের চার তলা থেকে নেমে পাকা রোড পেরিয়ে হাঁটতে লাগলাম। হাঁটতে,হাঁটতে সামনে একটা ব্রিজ বাঁধল। ব্রিজের ওপারে চোখে পড়ল একটা পাকা রোড। রোডটি দেখলে মনে হয় শিল্পীর সদ্য আঁকা কোন জীবন্তু ছবি। আমার মনে হতে লাগল,রোডের শেষে কিছু না কিছু আমি আবিস্কার করতে পারবোই,পারবো। যা অনুমান করেছিলাম,ঠিক তাই ঘটল। কিছু দূর যাওয়ার পর চোখে পড়ল একটি ছোট-খাট নদী। লোকের কাছে জিজ্ঞাসা করে জানতে পারলাম নদীটির নাম “কীর্তিনাশা”। বাহ! নামটি তো বেশ চমৎকার! আরোও জানা গেল এ নদী এমন ছিলনা,ছিল প্রচন্ড খর¯্রােতা। লঞ্চ,ষ্টিমার এসে ঘাটে ভিড়তো। মাদারিপুর থেকে ছেড়ে আসা লঞ্চ,ষ্টীমার শরীয়তপুর হয়ে ঢাকায় যেত। কালের বিবর্তনে সব এখন শুধু স্মৃতিতে জমা পড়ে আছে। হঠাৎ,এমন সময় চোখে পড়ল ভ্যানে করে এক যুবক কাঁতরাতে,কাঁতরাতে যাচ্ছে। পাশে বসা তার মা ও বোন। আমি এগিয়ে গিয়ে জিজ্ঞাসা করলাম,কি হয়েছে চাচী আপনার ছেলের? আর বাবা কইয়ো না হেই কতা,আমার ছেলের পাও দুইডা কুত্তার বাচ্চারা ভাইঙ্গা দিছে, দেহনা? কেমন পার তোন রক্ত পড়তাছে। বাবা,পারলে আমার পুলাডারে একটু কাত কইরে শুয়ায়ে দাও। 
এমনি সময় পাশে দাঁড়িয়ে থাকা দুই যুবক বলল,ভাই এই ছেলে বেশি ভাল না। এর জন্য গ্রামের লোকেরা ঘুমাতে পারে না ঠিক মত। ওদের কথা শেষ হতে না হতে ঘাড় ফিরিয়ে দেখি,সেই আহত ছেলেসহ তার মা চলে গিয়েছে। 
একি দেখলাম! শহরের কোলাহল ছেড়ে নির্জনতায় আসলাম। যদি একটু স্বস্তির নিঃশ্বাস নিতে পারি,কিন্তু এখানেও দানবের আক্রমন। এত সুন্দর একটা নদী। শান্ত হয়ে তার চলা। তার মাঝেও অশান্তি! আচ্ছা,এপারে নাই সমস্যা,কিন্তু নদীর ওপারেও কি এইরকম কুৎসিত মানুষের আবাস স্থল হতে পারে? হয়ত হতে পারে। না,এখানে মনে হয় বেশিক্ষণ থাকা ঠিক হবে না। এখান থেকে এ মূহুর্তে চলে যাওয়ায় ভাল হবে। তবে,আমাকে সুন্দরের অপূর্ন স্বাদ নিয়ে আবারও ফিরতে হল সেই কৃত্রিমতায় গড়া চার তলা মেসে।

সকাল ১০টায় অফিস। তাড়াতাড়ি গোসল সেরে অফিসে যেতে হবে। তবে,দুই-দশ মিনিট এদিক-ওদিক হলে ক্ষতি নাই। কারণ,ফোর ইনচার্জ লোকটি যথেষ্ঠ উদারমনা। হঠাৎ,এমন সময় মোবাইল বেজে উঠল। দেখি অনন্যা রিং করেছে। কি ব্যাপার এ সময় তো তুমি কখনও ফোন দাও না। কোন খবর-টবর আছে নাকি? না,তেমন ভাল কোন খবর নাই। তন্ময়ের সকাল থেকে গা কেমন গরম গরম মনে হচ্ছে। কেন কি হয়েছে ওর? মনে হয় জ্বর হয়েছে। বলো কি! শোন,সাথে দুই-তিনবার বমিও করেছে। এখন আমি কি করবো বুঝতে পারছি না। মা নেই বাড়িতে? না,তিনি তো ঢাকায় গেছে প্রায় ১০-১২ দিন হবে। এখন কাকে নিয়ে ডাক্তার খানায় যাব। কি করবো বুঝতে পারছি না। কথাগুলি শুনার পর আমার ভিতরে  কেমন একটা অস্থিরতা ভাব কাজ করতে শুরু করল। কথা বলতে গেলে কেমন একটা অদৃশ্য ছায়া আমাকে গ্রাস করতে লাগল। কি বলবো,কি করবো আমি এখন বুঝতে পারছি না। কারণ,শরীয়তপুর থেকে যশোর একটা লম্বা পথ। ইচ্ছা করলেও সহজে যাওয়া যায় না। তবুও কষ্ট বুকে চাপা দিয়ে বললাম,তুমি তাড়াতাড়ি ওকে নিয়ে ডাক্তারের কাছে যাও। আমি তো ইচ্ছা করলেও আসতে পারছি না তোমাদের কাছে। অনন্যা আমার অবস্থা বুঝতে পেরে বলল,আচ্ছা তুমি কোন চিন্তা কর না। আমি দেখছি কি করা যায়। বলেই ওপাশ থেকে অনন্যা মোবাইল সংযোগটি কেটে দিল। 
অফিসের দিকে হেঁটে যাচ্ছি চিন্তা-মগ্ন অবস্থায়। নিজেকে এখন খুব অসহায় মনে হচ্ছে! ছেলের অসুখের কথা শুনে,এখন আমার আর কিছু ভাল লাগছে না। মনে হচ্ছে এখন যদি পাখি হতাম তাহলে,ডানা ঝাপটিয়ে উড়াল দিতাম পুত্রের উদ্দেশ্য। পিছনে ফেলে রেখে যেতাম কীর্তিনাশা,আড়িয়াল খাঁ,রূপসা নদীর নীরবে নিভৃতে বয়ে যাওয়া পানির ¯্রােত। কিন্তু আমি অসহায় এক্ষেত্রে! মানুষকে নাকি শ্রেষ্ঠ জীব বলা হয়,আমার তো মনে হয় সব ক্ষেত্রে সেটা সঠিক না। পৃথিবীতে কিছু কিছু প্রাণি আছে যারা,মানুষের থেকে অনেক স্বাধীন,গতিময়,বেগবান। সেখানে তাদেরকে মানুষের পাশে দাঁড় করালে আমার কাছে মানুষকেই খুব ছোট মনে হয়। অফিসে ঢুকে ইচ্ছা না থাকলেও দাঁত বের করে সালাম সহ সবার সাথে শুভেচ্ছা বিনিময় করে নিজ চেয়ারে গিয়ে বসলাম। চোখের সামনে বসানো কম্পিউটারটির দিকে এক মনে চেয়ে আছি। কি যেন একটা কাজ ইন্টানেটের মাধ্যমে আজ করার কথা ছিল। কিন্তু ভুলে গিয়ে অন্য মনস্ক হয়ে ফ্যাল ফ্যাল করে টিভি মনিটরের দিকে তাকিয়ে থাকলাম। এমন সময় ফোর ইনচার্জ ইয়াদ হোসেন পিছনে থেকে আমাকে জিজ্ঞাসা করল,কেমন আছেন? ভাল। কি হিমালয় সাহেব,আজ আপনাকে দেখে কেমন চিন্তিত মনে হচ্ছে? শরীরটা কি আপনার খুব খারাপ নাকি? নীরবতা ভেঙ্গে উত্তর দিলাম,না,না ওসব তেমন কিছু না। না ভাই সেটা বললে হবে না। আমি স্পষ্ঠ দেখতে পাচ্ছি আপনি কোন একটা বিষয় নিয়ে গভীর চিন্তা করছেন। বাড়িতে কি কোন সমস্যা হয়েছে নাকি? আমার মুখে কোন কথা নাই। কি ব্যাপার ভাই কোন উত্তর দিলেন না যে? না,মানে ছেলেটার শরীর খুব খারাপ তো। তাই,মানুষিকভাবে একটু চিন্তিত আছি। কেন আপনার ছেলের কি বড় কোন কিছু হয়েছে নাকি? আর বলেন না ভাই,সকাল থেকে তার বমি,জ্বর শুরু হয়েছে। কেন ভাই,কোন ডাক্তারকে দেখান নি? আরে ভাই,ইচ্ছা করলেও আমি এখান থেকে বসে কিছু করতে পারছি না,আপনার ভাবি যতটুকু যা পারছে,তাই করছে। এর মধ্যে হঠাৎ করে অফিস কর্মকর্তা লিয়াকত সাহেব হাজির হল। তিনি পদবীতে অফিস এসিস্টেন্ট তবু তার ভাবের শেষ নাই। তিনি এসে আমাকে বললেন,দেখুন হিমালয় সাহেব আমি বলি কি ভাবিকে বলেন এদিক-ওদিক না ঘুরে ছেলেকে নাপা ঔষধ খাইয়ে দিতে। দেখবেন,খুব তাড়াতাড়ি আপনার ছেলে ভাল হয়ে গিয়েছে। এই রকম রুগি আমার হাতে বুঝলেন,হাজার হাজার ভাল হয়ে গিয়েছে। আপনি আর দেরি না করে ভাবিকে ফোন করে এক্ষুণি কথাটি বলুন। চিন্তার কোন কারণ নাই। এখন গরমের সময় তো এরকম একটু-আধটু হয়। বলে,উনি ধীরে ধীরে তার রুমের দিকে চলে গেলেন। 
চলে যাওয়ার পর ইয়াদ হোসেন বললেন,দেখলেন ভাই কত বড় ডাক্তারই না আমাদের অফিসে। শুনুন,উনার কথা না শুনে বরং আপনি ভাবিকে বলুন এক্ষুণিই ভাল কোন ডাক্তারের কাছে নিয়ে যেতে ছেলেকে। দেখবেন,আল্লার ইচ্ছায় সে ভাল হয়ে যাবে। আমার এই দুটি লোকের উপর এমন রাগ হতে লাগল,কিন্তু মুখে কিছু বলতে পারলাম না। শুধু বললাম,ভাই আমার শরীরটা বেশি ভাল লাগছে না,দয়া করে আমাকে একটু একা থাকতে দিন। ইয়াদ হোসেন দাঁত বের করে হাসি দিয়ে বলল,ঠিক আছে ভাই আপনি একা থাকেন পরে আসবো বলে তিনি চলে গেলেন। আমার সামনে পড়ে আছে অফিসের ফাইলের স্তুপ। ফাইলগুলি আমার দিকে তাকিয়ে আছে সেই কখন থেকে। কিন্তু পুত্রের অসুখে আমি বিহবল! কি করবে এই মুহুর্তে বুঝতে পারছি না। একবার মনে হল, ছুটি নিয়ে এক্ষুণি যশোরের দিকে রওনা হয়। কিন্তু মাসের শেষ হাতের অবস্থাও তেমন ভাল না। সব কিছু মিলিয়ে নেতিবাচক হয়ে আসছে প্রতিটিক্ষণ। মনে হচ্ছে,দূর থেকে তন্ময় দুই হাত তুলে ডাকছে আব্বু তুমি ফিরে এসো! আব্বু তুমি ফিরে এসো! তোমাকে পাচ্ছি না কেন? আমি যে বড় একাকিবোধ করছি। তুমি কবে আসবে আমার কাছে,আমার যে আর ভাল লাগছে না। কিন্তু আমি নীরব নিথর হয়ে শুধু দূর থেকে ভেসে আসা ছেলের আকুতি আমাকে গ্রাস করতে লাগল একটু একটু করে। হঠাৎ,বাহিরের আকাশ কালো হয়ে বাতাসের ঝপটা-ঝাপটি শুরু হয়ে গেল। জানালার পাশে থাকা আম গাছটির ডাল জানালার গ্লাসে বাড়ি মারতে লাগল ক্রমাগতভাবে। মনে পড়ল বৈশাখী ঝড়ের কথা। জানিনা,এ মুহুর্তে তন্ময় কি করছে। হয়ত বা ঝড়ের প্রথম দুলানি দেখে কেঁপে,কেঁপে উঠছে তার শরীর,মন সব কিছু। নয়তো বা মায়ের দুধ মুখে নিয়ে চুকচুক করে খেয়ে যাচ্ছে অবিরাম। নয়তো তার বাবার ছেঁড়া সেন্ডেল নিয়ে লুকিয়ে রাখতে চাচ্ছে খাটের তলে। কেউ চাইলে তাকে দিবে না বলে আগলে রেখেছে বুকের মাঝে। কারণ,এটা তার আব্বুর সেন্ডেল! হতে পারে অন্যর কাছে এটা মূলহীন জড় পদার্থ। কিন্তু তার কাছে এটা পৃথিবীর বড় সম্পদ! কিছুদিন আগে অনন্যা বলেছিল,জান তোমার ছেলে না একটা কান্ড ঘটিয়েছে। সে আবার কি ঘটালো? আর বল না,আমি তোমার জামা-প্যান্ট,জ্যাকেটটি ধুতে যাচ্ছিলাম,ঠিক তখনি সে আমার কাছ থেকে ঐগুলি সব হাত থেকে কেড়ে নিল। আর ভাঙ্গা ভাঙ্গা গলায় বলল না,না এটা আমার আব্বুর, এটা আমার আব্বুর। আচ্ছা তোমার ছেলে তোমাকে এত কি করে চেনে? আমাকে তো সে এভাবে চেনে না। অথচ,আমি তার সাথে থাকি সারাক্ষণ। এখানে-সেখানে আমার জামা-কাপড় পড়ে থাকে,সেগুলি নিয়ে তো তার কোন মাথা ব্যথা নেই। আহা! বুঝতে হবেনা ছেলেটি আমার। আমি বলেছিলাম না জন্মের আগে,আমার ছেলে একজন ব্যতিক্রম মানুষ হবে। তার বুদ্ধিমত্তা,ব্যক্তিসত্বা চলন-বলন থাকবে অন্যান্য শিশুদের থেকে সম্পূর্ন আলাদা। আর সেটা তুমি এখন থেকে টের পাচ্ছো। তুমি তো আমার এ কথা বিশ্বাসই করতে না। এখন মিলিয়ে দেখ,বয়স তুলনায় সে কত প্রখর বুদ্ধির অধিকারী। অনন্যা ওপাশ থেকে হেসে বলল,দেখছি,দেখছি সব। কিন্তু তুমি তো স্বার্থপর হয়ে গিয়েছো? কেন? কেন আবার বুঝো না? সারাদিন-রাত তোমার ছেলে কি খাচ্ছে না খাচ্ছে,কিভাবে চলছে না চলছে তাই নিয়ে তোমার মাতামাতি। কিন্তু আমার কথা ভাবার সময় কি তোমার নেই এতটুকু? কেন,আমি আবার কি করলাম? কি করলে,তুমি বুকে হাত দিয়ে বল তো আমাকে নিয়ে তুমি কতবার ভাবো দিনে? বিয়ের আগে তো আমাকে ছাড়া তোমার কোন কিছু চলতো না। সব কিছুর মূলে ছিলাম আমি। কিন্তু এখন আমি তোমার কাছে কিছুনা। ছেলেই তোমার কাছে সব। আহা! তুমি বিষয়টা এভাবে নিচ্ছো কেন? ও তো আমাদের একটাই ছেলে ওর সাথে তোমার তুলনা করা ঠিক হচ্ছে? ঠিক আছে তোমার কথা। আমি কারো সাথে কারোও তুলনা করছি না। কিন্তু আমাকে নিয়ে তুমি আর একটু ভাবো,এটা তোমার নৈতিক দায়িত্ব বলেই অমনি মোবাইলের সংযোগটি কেটে দিল। 
আমি মনে মনে ভাবতে লাগলাম,জগৎ বড়ই অদ্ভুত জায়গা! এত ভালবাসা,এত প্রেম এর এক একটির স্বাদ,গন্ধ আলাদা আলাদা। কেউ কারো থেকে কম নয়। তবে,সময়ের পরিবর্তনের কারণে এক একটি ভালবাসা ভিন্ন ভিন্ন রূপে আমাদের কাছে বিশেষভাবে প্রাধান্য পায়। যেটা আজ অনন্যা ও তন্ময়ের ক্ষেত্রে শুরু হয়েছে। আর একটা কথা এখানে না বললে নয়। এই ভালবাসার গভীরতা,ওজন,প্রশস্ততা,প্রিয়জনের কাছে থেকে যতটা না বুঝা যায়,দূরে থাকলে প্রতিটি অনুভূতির পাখাগুলি ভিন্ন ভিন্ন রূপে পরস্পর,পরস্পরের সম্মুখে নানা রঙে,নানা ঢঙে পেখম তুলে নৃত্য করতে থাকে। একথা,বর্তমানে এখন স্ত্রী ও পুত্র ভালবাসার বিচার-বিশ্লেষনে প্রমাণিত। আমি এখন পরিক্ষণ করছি পৃথিবীতে কোনটি বড়,কোনটি আমার কাছে এই মূহুর্তে অধিক গ্রহনীয়। কিন্তু বারবার কেন জানি মনে হচ্ছে পুত্র ¯েœহই আমাকে বেশি বেশি তার দিকে টানছে। তবে,স্ত্রীর ভালবাসা যে একবারেই ছোট ও ফিকে হয়ে গেছে আমার কাছে সেটা কিন্তু নয়,সেই ভালবাসার আছে অন্য রূপ,অন্য লাবন্য আমার কাছে। যাহা শুধু আমার হৃদয় জানে,অন্য কেউ নয়।

চারতলা বিশিষ্ট মেসে পা রাখার সাথে সাথে চোখে পড়ল দাদার দাঁত বের করা হাসি। কি ভাই আপনার আজ কেমন মন মরা,মরা লাগছে। কোন খারাপ কিছু হয়েছে নাকি? কোন সমস্যা হলে আমাকে বলতে পারেন,আমি আপনার সমস্যা সমাধান করে দিবো। না,দাদা আমার তেমন কিছু হয়নি। না ভাই,আপনি বললে তো হবে না। আপনার চোখ,মুখ দেখে স্পষ্ঠ বুঝা যাচ্ছে আপনার কিছু একটা হয়েছে। আর শরীর যদি খারাপই লাগে তাহলে বলেন,আমি আপনার ঔষধ দিয়ে দিচ্ছি। জানেন,আমার কাকা একজন বড় ডাক্তার। আপনি শুধু রাজবাড়ী মোড়ে নেমে যে কারো কাছে আমার কাকার নাম জিজ্ঞাসা করলে,আপনাকে সে নিজে নিয়ে গিয়ে বাড়িতে পৌঁছায়ে দিয়ে আসবে। আমার মুখে কোন কথা নেই। চুপচাপ বসে আছি খাটের কোনে। কি ভাই কিছু যে বলছেন না? আমার কথা কি আপনার বিশ্বাস হল না। না,দেখছি এবার বাড়িতে গেলে আপনাকে আমার বাসায় নিয়ে যেতে হবে। কি ভাই আমার সাথে যাবেন তো? ভাই কিছুতো একটা বলেন। আমি এবার নীরবতা ভেঙ্গে মুখ খুলে বললাম,দাদা আসলে আমার মন-মেজাজ বেশি ভাল নেই। তাছাড়া,আপনার ভাইপোর শরীরটা বেশি ভাল না। হ্যাঁ,যা আমি আন্দাজ করেছি,ঠিক তাই হয়েছে এর ব্যতিক্রম নয়। এবার বলুন তো ভাইপোর কি হয়েছে? ভগবানের কৃপায় আপনার ছেলেকে যে ঔষধ দিব না,সে তাতেই ভাল হয়ে যাবে। আমি সকাল থেকে এর ওর কাছ থেকে ঔষধের প্রিসক্রিপশনের সাজেশন নিতে নিতে কান্ত হয়ে পড়েছি। তাই,আর কারো কোন কথা আমার কাছে ভাল লাগছে না। সুতারং,রাগন্বিত হয়ে বলে উঠলাম,দাদা আপনাকে না বলছি আমার মন মেজাজ ভাল নেই। দয়া করে এবার আপনার মুখটা বন্ধ রাখবেন? দাদা আবারও দাঁত বের হেসে বলল,কি বলছেন ভাই! আপনার এই দুঃসময়ে আমি চুপ করে থাকবো। আপনার ছেলে কি আমার ছেলে না? আচ্ছা যাক ভাই,একটা বিষয় নিয়ে আপনার সাথে কথা বলতে চেয়েছিলাম। বলুন। না,বলছিলাম কি শুনলাম আপনি নাকি ভাল ইংলিশ বলতে জানেন? কে বলল আপনাকে? না দাদা,আপনি মুখে যতই বলেন আপনি জানেন না। তাতে কিন্তু আমার বিশ্বাস হয় না। আচ্ছা ঠিক আছে আমি জানি,তো কি করতে হবে আপনার জন্য? না,বলছিলাম কি যদি একটু আমার জন্য সময় দেন,তাহলে আমার খুব উপকার হয়। দাদা,আমি আপনার বিষয়টা ঠিক ভাল করে বুঝলাম না। দয়া করে বিষয়টি একটু খুলে বলুন। না,মানে বোঝেন তো মার্কেটিং চাকরি করি। আমাদের চাকরিতে যদি অনর্গল ইংলিশে কথা বলতে পারা যায়,তাহলে আমার প্রমোশন হবেই হবে। সাথে সাথে আমার ভাগ্যটাও ঘুরে যাবে। মানে,আমার বেতন হবে প্রায় পঞ্চাশ হাজারের উপরে এবং একটা লেপটপও পাবো সাথে চার চাকাওয়ালা গাড়ি। বলেন দাদা জীবনে আর কিছু লাগে? সবাই তো একটু সুখের মুখ দেখতে চাই। আর দাদা সাথে আমি একথাও বলে রাখছি,যদি আমার প্রমোশন হয়, তাহলে কিন্তু আপনাকে আমাদের কোম্পানিতে জয়েন্ট করতে হবে। দরকার হলে দুই ভাই এক সাথে ফাট নিয়ে থাকবো। দাদা,বড় লোক হতে আর কতক্ষণই বা লাগবে বলুন! আমি দাদার কথা ও স্বপ্ন দেখানোর বাণী শুনে রীতিমত হতবাক হয়ে গেলাম! নীরবে দাদার মুখের পানে চেয়ে রইলাম কিছুক্ষণ। 
হঠাৎ আমি বিছানা ছেড়ে উঠে বললাম,দাদা আপনি বসেন,আমি আসছি। বলে ছাদের ব্যালকলি ধরে দাঁড়িয়ে রইলাম পূর্ণিমার চাঁদের দিকে তাকিয়ে। জোৎ¯œা মাখা চাঁদকে থেকে থেকে কালো মেঘ চুমু দিয়ে সরে সরে যাচ্ছে। কিছুক্ষণ পর আবার চাঁদ তার স্ব-মহিমায় নিজেকে মেলে ধরছে পৃথিবীর বুকে। আবার ফিরে পাচ্ছে তার নিজেকে সামনে এগিয়ে নেওয়ার প্রবল বাসনা। হয়ত জীবনটাই এমন কখনও আলো,কখনও অন্ধকার। আজ তন্ময়ের শারীরিক অসুস্থতার সাথে চাঁদের অবস্থানের মিল করতে লাগলাম। এই মূহুর্তে মনে হচ্ছে আমি যদি এই কালো মেঘের বন্ধু হতাম,তাহলে কতই না ভাল হত! তাহলে একটি বারের জন্য হলেও আমার ছেলেকে দেখতে পেতাম। নিতে পারতাম তার বুকের মাঝে লুকিয়ে থাকা কোমল সুগন্ধযুক্ত মায়াময় আদর। হয়ত আমাকে দেখে তার শারীরিক অসুস্থতাও কেটে যেত। ঝাঁপিয়ে পড়ত আমার কোলে। এ সুখ,এ আনন্দ শুধু পিতা-পুত্রই বোঝে,অন্য কেউ নয়। ¯্রষ্টা যে কি মিহিন সুতা দিয়ে এদের হৃদয়ের বন্ধন তৈরি করেছে তা শুধু পৃথিবীর পিতা-পুত্রই বুঝবে এ আবেগের অভিধান। আমি জানি,মেঘেদের সাথে আমার বন্ধুত্ব সম্ভব নয়। সম্ভব নয় তাদের সাথে উড়ে চলা। এখন শুধু নীরবে হতাশাকে মেনে নেওয়া ছাড়া অন্য কোন উপায় নাই। তবু মেঘকে বলি যদি পার তাহলে আমার এ হৃদয়ের খবরটা তাকে বলে দিও। আমি যে তার জন্য কত ব্যাকুল হয়ে বসে ভাবছি তার কথা!

ওদিকে আমার অফিসের ফোর ইনচার্জ ইয়াদ হোসেন সব সময় বেজায় খুশিতে থাকে। কারণ,অফিসের ফোর ইনচার্জ হওয়ার পর অফিসের সমস্ত দায়িত্ব ও সর্বচ্চ পদাধিকার এখন তার হাতের মুঠোয়। তাই,তার খুশির অন্ত নেই। যদিও সে পদবীতে জুনিয়র অফিসার। কিন্তু রাতারাতি পদাধীকার বলে এক লাফে সে গাছের আগায় বসে ভাব-গাম্ভীর্যের সহিত অফিসের সবকিছু অবলোকন করিতেছে। কিন্তু ওদিকে তার তীব্র প্রতিদ্ধন্ধি আর এক কর্মকর্তা লিয়াকত আলী হিংসায় জ্বলে-পুড়ে  বড়ই মনে কষ্ট পাচ্ছে। ইয়াদ হোসেন ফোর ইনচার্জ হওয়াতে স্পষ্ঠ বোঝা যায় সে একটা বেশি খুশি না। সে সুযোগ পেলে,একে-ওকে তার সম্পর্কে বদনাম করবে। তবে,মাঝে মাঝে যে এসব কথা তার কানে যায় না,তা ঠিক না। যদি কখনও বা তার কানে যায় এসব কথা,তাহলে সে কোন গুরুত্বই দেয়না। বরং,স্ব-গর্বে হেঁটে চলে পুনরায়। যাক,সেসব কথা। আমি এখন লিয়াকত আলীর সামনে বসে আছি।কি ব্যাপার ভাই কেমন আছেন? আরে হিমালয় ভাই,আমাদের থাকা আর না থাকার কথা জিজ্ঞাসা না করে বরং আপনার ফোর ইনচার্জের কাছে গিয়ে এ কথা বলেন। সে তো এখন বিশাল ফর্মে আছে! ব্যাটে-বলে রানও পাচ্ছে প্রচুর। আরে ভাই,দিন তো তার। আমি,আপনি কেমন থাকি বা না থাকি সেটা কোন বিষয় নয়। লিয়াকত ভাই,আজ ইয়াদ ভাই ফোর ইনচার্জ হয়েছে,আগামিতে আপনি হবেন। এতে,মন খারাপ করার কি আছে? আরে ভাই,এটা কোন কথা কইলেন। কথায় বলে না কানার আবার দিন কিবা রাত! আরে ভাই খবর তো কিছু রাখেন না,আপনি জানেন সে কিভাবে ইনচার্জের দায়িত্ব পেল। না। তাহলে তো আপনি কোন কিছুরই খবর রাখেন না ঠিক মত। আরে ঐ বেটা,আগের যে সুবেদার সাহেব ছিলনা,সেই শালারে সে বাপ ডাকছিল। যার দরুন,সে এত বড় পদবিটা পাইলো। বোঝেন না ভাই,দেশটা হয়ে গেছে এখন তেল মারার জায়গা। আপনি যত বেশি তেল মারতে পারবেন,আপনি ততই উন্নতি লাভ করতে পারবেন। আপনি পারবেন না,তো আপনার কিছুই হবে না। আমি সুযোগ বুঝে বলে বসলাম,ভাই তাহলে আপনি তো একটু তেল মারতে পারতেন, পারতেন না? লিয়াকত ভাই ইতস্তত হয়ে বলল,না,না ভাই। আমার দ্বারা এসব সম্ভব নয়। বোঝেন না কেন,আমি হল একটা বংশিয় ঘরের লোক! আমাদের বংশে এসব তেল মারামারি নেই। আপনি জানেন,তার আরোও কান্ড-কারখানার কথা! কেন ভাই সে কি করেছে? আচ্ছা ভাই,এবার আপনি বলুন তো তার বয়স কত হবে? কত আর হবে। এই ধরেন ৩৭-৩৮ বছর। আরে কন কি আপনি! হেয় কয় তার বয়স ৩৭-৩৮। আসলে তার বয়স ৪৩-৪৪ বছর? বোঝেন না,মুখ দেখলে বোঝা যায় সে একটা বুড়া ধামড়া। জানেন,তার সাথে ধামড়ার পার্থক্যটা কি? কি? ধামড়া হাম্বা,হাম্বা করে ডাকে আর সে ডাকে না। আপনি সত্য বলছেন লিয়াকত ভাই!  তাহলে কি আমি মিথ্যা বলছি। আপনি এই অফিসে আসছেন আর কত দিন,আরো কিছুিদন থাকেন,তাহলে সবকিছু আপনি দেখতে পারবেন। ভাই,আমি তো প্রায় দুই মাস হয়ে গেল এখানে এসেছি,এমন কিছু তো আমার চোখে পড়ল না। পড়বে,পড়বে আরোও কিছু দিন অপেক্ষা করুন। শোনেন ভাই,আমার কপালটাই খারাপ! কেন আবার কি হল? আরে ভাই,আমার সব বন্ধুরা এখন কেউ এম.পি,কেউ বড় ,বড় আমলা আর আমি পড়ে আছি এখানে। বুঝছেন ভাই,বেশি দিন আর এই চাকরি করবো না। আর কিছুদিন পর আমার এন.জি.ওটা ভাল করে চললে এসব চাকরির আর দরকার হবে না। তখন আমি নিজেই মানুষেরে চাকরি দিব। কি বলেন লিয়াকত ভাই,আপনার একটা এন.জি.ও সংস্থাও আছে নাকি! আরে ভাই,এটা আপনি নতুন শুনলেন? এমনই সময় হঠাৎ ইয়াদ হোসেন ডাক দিল পিয়ন রাসেলকে। ঐ দেখেন ভাই তার কান্ড-কারখানা! ডাকটা এমনভাবে দিল মনে হয় সে এই দেশের প্রেসিডেন্ট আর আমরা তার প্রজা! 
লিয়াকত ভাই এবার আমাকে উঠতে হবে,দেখি অফিসের কোন কাজ-কর্ম পড়ে আছে কিনা।
কি আর কাজ-কর্ম করবেন,আর একটু বসেন। না,না আমি এখন যাই। পরে এসে আপনার সাথে চুটিয়ে গল্প করবো। যেই আমি চেয়ার ছেড়ে উঠতে যাব,সেই পিছন ফিরে দেখি রাসেল দাঁড়িয়ে আছে। মুখ দেখে মনে হয় সে কিছু বলবে। কি ব্যাপার রাসেল,কোনো কিছু বলবে? জিঁ স্যার। ইয়াদ স্যার আপনাকে তার রুমে সালাম দিছে। কেন? স্যার,সেটাতো আমি কিছু বলতে পারবো না। আচ্ছা ঠিক আছে তুমি যাও,আমি আসছি। তার কিছুক্ষণ পর আমি ইনচার্জের রুমে ঢুকলাম সালাম দিয়ে। ইয়াদ ভাই,আপনি কি আমাকে স্বরণ করেছেন? 
মুখটা কেমন গম্ভীর! হ্যাঁ,বসুন। আপনার হাতে কি তেমন কোন অফিসিয়াল কাজ-কর্ম নাই? জিঁ না,এই মুহুর্তে কোন কাজ নাই। তাহলে,আপনি আমার এখানে বসুন এবং আমার সাথে গল্প করুন। কিন্তু ঐ খচ্চরের সাথে নয়। আমি অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করলাম,ভাই আপনি খচ্চর কাকে বলছেন? কেন বুঝছেন না,ঐ পাশের রুমের লিয়াকত আলীকে। ব্যাটা সুযোগ পেলেই আমার বিরুদ্ধে কথা বলবে। কিন্তু ভাই আমি কার সাথে কথা বলবো,কি বলবো না সেটা আমার একান্তই ব্যাক্তিগত ব্যাপার। আর সেটা নিয়ে আপনি কোন কথা বলতে পারেন না। 
ইয়াদ হোসেন এবার দাঁত বের করে হেসে বলল,ঠিক আছে আপনার ব্যক্তিগত বিষয়। কিন্তু অফিস ম্যানেজম্যান্ট বলে একটা কথা তো আছে। আপনি যেন ভাই এতে কিছু মনে করবেন না। আমি নিজেকে সংবরন করে বললাম,ঠিক আছে ভাই আপনার কথা। কিন্তু শুনুন ভাই,আপনি নিশ্চিত থাকবেন,আপনার বিরুদ্ধে কোন অন্যায় কথা হলে আমি অবশ্যই তার প্রতিবাদ করবো। এটা নিয়ে আপনি কোন দুঃশ্চিন্তা করবেন না। বলেই চেয়ার ছেড়ে উঠে নিজের রুমে গিয়ে বসলাম।

গত পাঁচ দিন হল তন্ময়ের গায়ে জ্বর। কিন্তু সুস্থতার কোন লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। তবে এর মধ্যে অনন্যা আমাকে জানিয়েছে,জ্বর সকালে চলে গেলেও আবার রাত্রে আসছে। শুনে আমি আরোও চিন্তিত হয়ে পড়লাম। এটাতো দেখছি স্বাভাবিক জ্বর না। তাহলে তো ভাল ডাক্তার দেখাতে হয়। জ্বরের উপসর্গ দেখে বুঝা যাচ্ছে জ্বরটি মোটেই ভাল না। এদিকে,মা গিয়েছে ঢাকায় নিজের চিকিৎসার জন্য। তার ইদানিং ডাইবেটিকসটা বেশি দেখা দিয়েছে। কিন্তু কবে কোন দিন যে তিনি ফিরে আসবে যশোরে তার কোন ঠিক নেই। আমি ফোন করলাম মার কাছে। মা জানিয়ে দিল,বাড়িতে ফিরতে তার আরোও দেরি হবে। বর্তমানে অনন্যা ও তন্ময় অবস্থান করছে এত বড় বাড়ীতে। বড় ভাবী ও তার ছেলে-মেয়ে নিয়ে খুলনাতে গিয়েছে। তাদেরও  আসতে ১০-১২ দিন লাগবে। সব মিলিয়ে পরিস্থিতি প্রতিকূলে। অনন্যা বিকালে আবার আমাকে ফোন দিল। কি হল আবার? শোন,তন্ময়ের তো জ্বর মোটেই কমছে না। এখন এ মুহুর্তে যে আমি কি করবো তা বুঝতে পারছি না। কেন,ডাক্তার এখন কি বলছে? ডাক্তার আবার কি বলবে। সে যেসব ঔষধ দিয়েছিল,সেইগুলি আমি খাইয়ে দিয়েছি। কিন্তু ফলাফল তো কোন কিছু পাচ্ছি না। আমি বলছি একটু ভাল ডাক্তার দেখালে কি হয়? ঠিক আছে দেখাও আমার কোন আপত্তি নাই। তুমি তো বলছো আপত্তি নাই। কিন্তু আমি তো জানি তোমার পকেটের অবস্থা। এখন ডাক্তারখানায় গেলে কমপক্ষে এক হাজার টাকার নিচেয় কিছু হবে না। আরে! এখন টাকার কথা না ভেবে বাচ্চাকে নিয়ে ডাক্তারের কাছে যাও। কিন্তু আমার কাছে তো মাত্র দুইশত টাকা আছে। আমি জানি এ ধরনের সমস্যা যখন-তখন হতে পারে। তাই,অনন্যাকে কোন কিছু না জানিয়ে খাটের তলায় স্যুটকেসে সাতাশ শত টাকা রেখে আসছিলাম,গতবার বাড়ি যাওয়ার সময়। কিন্তু এখন ঠিকই বুদ্ধিটা কাজে লাগছে। তবে,আমার চিন্তা ছিল আরোও কিছু টাকা জমা হলে,আমার কিছু পুরানো দেনা ছিল,সেটা পরিশোধ করবো। কিন্তু সেটা আর হল না। এখন আমার কাছে পুত্রের নিরাপত্তায় বড় হয়ে দাঁড়িয়েছে। শোন অনন্যা,তুমি খাটের নীচেয় দেখ একটা স্যুটকেস আছে। তার ভিতর দেখ কিছু টাকাও রাখা আছে। তোমার প্রয়োজন মত টাকা খরচ কর সেখান থেকে। তবে মনে রেখ,ঐ কিন্তু আমার বর্তমান সম্বল। ওটা সব শেষ হয়ে গেলে কিন্তু তোমাকে পরবর্তী মাসের জন্য অপেক্ষা করতে হবে। আচ্ছা,আচ্ছা আমাকে এত সব খুলে বলতে হবে না। আমার এটা বুঝ আছে। কখন কি করতে হবে। তবে,তুমি যে ওখানে টাকা রেখেছো সেটা আমাকে একবার বলতে পারতে। হ্যাঁ,ভালই বলেছো। বলি,আর সব টাকাগুলি মুহুর্তের মধ্যে শেষ হয়ে যাক। ও তাহলে তোমার আমার উপর এই বিশ্বাস! আরে তুমি বুঝনা কেন,আমি তোমার সাথে একটু ফাজলামি করছিলাম। আর তাতেই তোমার এ অবস্থা! শোন,এখন এসব মান-অভিমান ভুলে গিয়ে দ্রুত ছেলেটিকে ডাক্তারের কাছে  নিয়ে যাও।  আচ্ছা, যাচ্ছি গো যাচ্ছি। অনন্যা যখন বোরকা ও নতুন কাপড় পড়বে বলে ঠিক করল,ঠিক তখন তন্ময় বুঝতে পারল তার আম্মু নিশ্চয় বাহিরে যাবে। সাথে সাথে সেও বায়না ধরল তাকেও নতুন কাপড়-চোপড় পরিয়ে দিতে হবে এবং শুধু তাই না,সে নিজেই তার কাপড়-চোপড় বের করে এনে আম্মুর কাছে এনে দিয়ে ভাঙ্গা,ভাঙ্গা গলায় বলল,আম্মাু এইটা,আম্মু এইটা। অর্থ্যাৎ,এই নতুন জামাটা তাকে পরিয়ে দাও। যদিও তার আম্মু অন্য একটি জামা পরাতে চাইছে। কিন্তু হবে না,ছুঁড়ে ফেলে দিল সেই জামা। বাধ্য হয়ে তাকে পরাতে হল তার পছন্দের জামা। তা না হলে মেজেতে শুয়ে পড়ে কান্নাকাটি শুরু করে দিত। তখন আর থামানো যেত না। তাই এ মুহুর্তে তার পছন্দকে প্রাধান্য দেওয়া হল। অনন্যা তন্ময়ের পছন্দ করা লাল জামাটি পরিয়ে ডাক্তারের উদ্দেশ্য রাওনা দিল। অনন্যা ও তন্ময়ের সাথে ছিল পাশের বাড়ির একটি মেয়ে। ডাক্তারের চেম্বারে যাওয়ার সাথে সাথে চোখে পড়ল একটা লম্বা ভিড়। এখন কি উপায়! এই ছেলেকে নিয়ে এতক্ষণ দাঁড়ান তো সম্ভব নয়! যাহোক,নার্সকে ঘুস দিয়ে ডাক্তারের সামনে যখন হাজির হল। তখন তন্ময় আর একটা কান্ড ঘটিয়ে বসল। ডাক্তার যখন তাকে দেখার উদ্দেশ্য বুকের ভিতর হাত দিল,তখন ডাক্তারকে কোন কিছু করতে না দিয়ে তার চশমাটিকে চোখ থেকে কেড়ে নিল। 
বাবু আমার চশমাটা ফেরত দাও। সে এখন এটা আর দিবে না তাকে। অনন্যা শত অনুরোধ করার সত্ত্বেও না। মহাবিপদে পড়ল অনন্যা! তারপর অনন্যা না পেরে একটা জোরে ধমক দিয়ে হাত থেকে চশমা কেড়ে নিল। সাথে সাথে তন্ময় হাত-পা ছুঁড়ে কান্নাকাটি শুরু করে দিল। তারপর ডাক্তার মাইক্রোসকোপটি হাতে দেওয়ার পর তার কান্না শেষ হল। ডাক্তার ভাল করে পরিক্ষা করে দেখে বলল,আপনার বাচ্চার রক্ত ও মুত্র পরিক্ষা করতে হবে।  ডাক্তার সাহেব,এইগুলি পরিক্ষা করাতে আমার কত টাকা লাগবে? কত আর লাগবে,ধরুন হাজার খানেক টাকা। দেখুন আপা,টাকার থেকে কিন্তু বাচ্চার জীবনের মূল্য অনেক বেশি। তারপরও আপনার চিন্তার কোন কারণ নাই,আপনি আমার কথা এই কিনিকে গিয়ে বলবেন,অবশ্যই আপনার কাছ থেকে তারা কিছু টাকা কম নিলেও নিবে। অনন্যা তাড়াতাড়ি সেখান থেকে বেরিয়ে এসে সেই ডাক্তারের লেখা দেওয়া কিনিকে গেল। কিনিকের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা টেষ্টগুলি দেখে বিল চার্জ বলে দিল ১২০০ শত টাকা। এবং সাথে এটাও বলে দিল এর একটি টাকাও কম হবে না। কিন্তু ডাক্তার সাহেব যে বলল,তার এই প্রিসক্রিপশন দেখালে টাকা একটু কম নিবেন। দেখুন ম্যাডাম,উনারা এসব কথা বলতে পারে। জানেন,উনারা যখন কমিশনের টাকাটা নিতে আসে,তখন একটি টাকা কম দিলে ওদের মুখের দিকে তাকান যায় না। এখন আপনাকে এগুলি টেষ্ট করাতে হলে বারশত টাকাই লাগবে। অনন্যা উপায়ান্তর না দেখে আমর কাছে ফোন দিল। কি ব্যাপার,আবার কি হল? শোন,এখানে উনারা বলছে বার শত টাকা লাগবে এগুলি টেষ্ট করাতে। কেন,কয়টা জিনিস পরিক্ষা করতে হবে? মোট দুইটা টেষ্ট দিয়েছে। কি বল! হল সামান্য জ্বর আর তাতেই টেষ্ট। এসব ব্যবসা ছাড়া কিছু না। দেখ,এসব কিছুই লাগবে না। কিন্তু তুমি বলছো কিছু লাগবে না। তারপর যদি বড় কিছু হয়ে যায়! তার চেয়ে টাকার দিকে না তাকিয়ে টেষ্টগুলি করিয়ে ফেলা ভাল। আমি আর কোন কথা না বাড়িয়ে টেষ্ট করার অনুমতি দিলাম। পরবর্তীতে টেষ্ট করিয়ে দেখা গেল,মূলতঃ তার কিছুই হয়নি,শুধু জ্বর ছাড়া। মাঝে পড়ে বেশ কিছু টাকা বেরিয়ে গেল। তারপর ডাক্তারের কাছে যখন যাওয়া হল। তখন শুধু এন্টিবাইটিক ঔষধ ছাড়া আর কিছু লিখে দিল না। আর ঐ ঔষধ খাওয়ানোর পর দেখা গেল জ্বর আস্তে আস্তে নামতে শুরু করল। তবে,যে ক‘দিন তার শরীরে জ্বর ছিল,সেই ক‘দিন বিছানাতে শুধু আব্বু,আব্বু করে ডাকা ছাড়া তার কোন কাজ ছিল না। আসলে,তন্ময়ের যে অসুখটা হয়েছিল,সেটা কোন শারীরিক রোগ ছিল না,সেটা ছিল মানসিক। সেটা ছিল পিতৃ ভালবাসার প্রতি তীব্র ক্ষুধা! সেই ভালবাসার অভাব পূরণ করে দিতে পারে শুধুমাত্র একজন পিতা। কোন ডাক্তার,কবিরাজ নয়। এ কথা আমি,অনন্যা,তন্ময় সবাই বুঝি। তবুও বিকল্প পদ্ধতির কাছে ছুঁটে যেতে হয় বারবার। এ ছাড়া আর উপায় কি আছে! 
প্রতিটি মানুষ যার যার জায়গায় কিছু দায়বদ্ধতা থাকে,তার সেই দায়বদ্ধতাকে এড়িয়ে চলা কোন দায়িত্বপূর্ণ মানুষের কাজ হতে পারে না। তাই,আমি পুত্রের  অসুস্থতার কথা শুনেও অফিস থেকে ছুটি নিয়ে যশোরে আসতে পারছি না। তবে,সামনের মাসে ৮,৯ তারিখের দিকে ছুটি আমাকে নিতেই হবে। কারণ,বহুদিন যাওয়া হয় না যশোরে। আর এবারে যাওয়ার একমাত্র কারণ তন্ময়।

হিমালয় নিজ বিছানাতে মাথার উপর হাত রেখে,তাকিয়ে আছে সিলিং এর দিকে এক মনে। জানিনা,এখন তন্ময় কি করছে। সেকি আমার কথা ভাবছে,না অসুখে কান্নাকাটি করছে। না মায়ের দুধের উপর মুখ রেখে চুকচুক করে দুধ খাচ্ছে অনবরত। জানিনা কিছুই তবু তাকে নিয়ে আমার সব চিন্ত-ভাবনা। এর মধ্যে রাজকুমার দাদা অনেকক্ষণ ধরে খেয়াল করে দেখল আমি কিছু একটা ভাবছি। হঠাৎ,সে প্রশ্ন করে বসলো। দাদা মনে হয় কিছু একটা ভাবছেন? ওপাশ থেকে কোন উত্তর নাই। আসলে,কথাটা আমি ঠিক মত বুঝতে পারলাম না। আবারও সে প্রশ্ন করল দাদা কিছু কি ভাবছেন? এবার আমি বললাম,বলুন কি বলবেন? না বলছিলাম কি আপনার মুখ দেখে মনে হচ্ছে আপনি কিছু একটা দুঃচিন্তা করছেন। বিষয়টা কি আমাকে বলা যাবে। কই নাতো তেমন কিছু না। না,না ভাই মুখ দেখে সেটা কিন্তু মনে হচ্ছে না। আরে ভাই,মানুষ সমস্যায় পড়লে তার নিকটতম মানুষের কাছে তার সমস্যার কথা বলে হালকা হয়। আর আপনি কিনা লক্ষ্য করে দেখেছি এসবের ধারে কাছেও নেই। আসলে ব্যাপারখানা কি আপনার? বলুনতো ভাই,আপনি আমাকে বিশ্বাস করেন না? কেন আপনাকে কি আমি তাই বলেছি? না ঠিক তা আপনি বলেন নি। কিন্তু আপনার কাজ কর্ম দেখে তো আমার সেটাই মনে হচ্ছে। 
দাদা দেখুন,আমি একটা সমস্যার ভিতর আছি। দয়া করে,এবার আপনার বকবকানিটা থামালে আমি খুশি হতাম। মুখটা প্রসস্ত করে বড় একটা হাসি দিয়ে বলল,দেখলেন তো ভাই আমার অনুমানই সত্য। আমি আপনার সমস্যাকে নিজের মনে করছি,আর আপনি কিনা আমাকে বলছেন বকবকানি করছি। শুনুন দাদা,আপনি একবার মুখ খুলে কিছু বলে দেখুন। আপনার জন্য আমি জান উৎসর্গ করে দিব। আমি দেখলাম,এই পাগলকে আর থামানো যাবে না। মনে মনে খুব হাসিও পাচ্ছে আবার রাগও হচ্ছে। কিন্তু কোন উপায় নাই ওকে থামানোর। তার চেয়ে ওকে বলতে দেওয়াটাই বুদ্ধিমানের কাজ। শুনুন ভাই আমি বলছি,আপনার ছেলের অসুখ খুব তাড়াতাড়ি ভাল হয়ে যাবে। আমি জানি,বর্তমানে ঋতু পরিবতনের কারণে মানুষের বেশ কিছু রোগ বালাই দেখা দিয়েছে,এতে ভয়ের কিছু নাই। আমি মুচকি হেসে বললাম,কিন্তু দাদা আমার ছেলের যে অসুখ সেটা আপনি কি করে বুঝলেন? বুঝি,বুঝি এত কিছু বুঝি আর আমার ভাইপোর জ্বর হয়েছে কিনা সেটা আমি বুঝবো না। তাই বলি কি,বেশি চিন্তা করে কোন লাভ নাই। বরং,আনন্দ করে দিন কাটানোটাই ভাল। এই আপনি আমাকে দেখুন,আমারও কি কম সমস্যা আছে। কিন্তু আমি কাউকে কিছু বুঝতে দেয় না। আমি অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করলাম,আপনার আবার কি সমস্যা! আর ভাই বলেন না,যে মাসে মনে করি একটু খরচ বাঁচাবো,ঠিক সেই মাসে দেখি খরচটা আমার বেড়ে গিয়েছে। এই ধরুন,এই মাসের কথাই বলি। সব কিছুই ঠিকভাবে চলছিল,হঠাৎ আজ বাড়ি থেকে খবর আসল আমার বাবা নাকি বাড়ির পাশে বাঁশের ঝাড়ে বসে বাঁশ কাটতেছিল। কি করে নাকি একটা বাঁশ বাবার উরুতে ঢুকে গিয়েছে। উনার বাঁশ যে ঢুকেছে ঠিক আছে কিন্তু বাহির করতে গেলে বাঁধছে যত সব বিপত্তি। বয়স্ক মানুষ,বাঁশটি উপরের দিকে টানলে লাগে ব্যথা,আবার নীচের দিকে টানলেও লাগে ব্যথা। তারপর,শেষ-মেষ ডাক্তারখানায় নিয়ে গিয়ে বহু কষ্টে বাঁশটি বের করা হয়েছে। কথাগুলি শুনে,আমার মুখের কোণে মৃদু হাসি দেখা দিল। আমি মনে মনে ভাবলাম,ব্যাটার মলদ্বারে ঢুকিনি ভাগ্য ভাল। লোকে মুখে শুনেছি,পাছায় বাঁশ দেওয়ার কথা। কিন্তু বাস্তবে দেখিনি। তাহলে,এবার অদেখা গল্প বাস্তবে পরিণত হত। ভাই,আমার কথা শুনে আপনি মনে হয় কিছু ভাবছেন? না তেমন কিছু না। 
তেমন কিছুনা বললে হবে। তাহলে যে আপনি মুচকি,মুচকি হাসছেন। আরে ভাই,এত গেল একটা সমস্যা। আরোও অনেক সমস্যা আছে আমার। ছোট একটা বোন আছে বিবাহযোগ্য। কিন্তু শত চেষ্টা করেও বিয়ে দিতে পারছিনা। কারণ একটাই সমস্যা,সেটা হল টাকা। তারপর,বোনটির আমার মেধা শক্তিও বেশি ভাল না। কত জায়গায় চেষ্টা করেছি একটা চাকরি দেওয়ার। কিন্তু সেই গুড়েও বালি! সবাই বলে রিটেনে টিকতে হবে। আরে, রিটেনে টিকার মত ক্ষমতা না থাকলে,সে রিটেনে টিকবে কিভাবে? এই কথাটা কাউকে বুঝাতে পারলাম না। এদিকে দিন দিন বোনটির বয়সও বেড়ে যাচ্ছে। সাথে সাথে চেহারাতেও উজ্জ¦লতার ছাপ কমে যাচ্ছে। এখন বলুন তো,আমি কোথায় যায়! এছাড়া আরোও আছে অনেক সমস্যা,সেইগুলি আমি আপনাকে অন্যদিন বলবো। 
আমি একটু হেসে বললাম,ঠিকই বলেছেন আপনার সমস্যা অনেক বেশি। কিন্তু এত কাছে থেকেও সেটা আমি বুঝতে পারিনি।

আজ হিমালয়ের মনটা বেশি ভাল নাই। তাই,সে অফিস থেকে ছুটি নিয়েছে। ওদিকে রাজকুমার দাদা তিনি একটা বড়  দার্শনিকের মত ভাব নিয়ে তার খাটের উপর বসে আছে। কি মনে করে ধ্যান ভঙ্গ করে বলল,ভাই আপনাকে যে একটা কথা বলেছিলাম,সেটার তো আপনি কিছু বললেন না? কোন বিষয়ে বলেছিলেন দাদা? কেন বলেছিলাম না ইংলিশ শেখানোর বিষয়। ওহ! মনে পড়েছে। তো শিখতে চাইছেন,শিখবেন। তাহলে আজই হয়ে যাক,আপনার যদি আপত্তি না থাকে। না,না আমার কোন আপত্তি নাই। সাথে সাথে দাদা আর দেরি না করে এক লাফে খাতা-কলম নিয়ে হাজির। নিন ভাই এবার শুরু করুন। 
আমি মনে মনে ভাবলাম,এত দেখছি আচ্ছা পাগলের পাল্লায় পড়েছি আমি। আজ একটু ছুটি নিলাম বিশ্রাম নিব বলে। কিন্তু সেই সুযোগ নাই। মুহুর্তের মধ্যে শুরু হয়ে গেল ইংলিশ শেখানোর অভিযান। কিন্তু শিখাতে গিয়ে দেখা গেল এক বিপত্তি,শিখানোর সময় সে এমন ভাবটা করতে লাগল যেন সে সব কিছু জানে। এখন জাষ্ট,সে রিভিশন দিচ্ছে। আমি রেগে গিয়ে বললাম,দাদা কোন কিছু শেখানোর সময় যে শিক্ষা দেয় তার কথা মেনে চলতে হয়। হোক সে সম-বয়সি অথবা বড়,তাহা না হলে কিন্তু মা স্বরস্বতি তাকে আশির্বাদ করে না। কেন ভাই,আমি কি কোন অপরাধ করেছি? না,তবে আমি যা বলবো,তাই একটু মেনে চলার চেষ্টা করবেন। তাতে আপনার বরং উপকারই হবে। দাদা এবার দাঁত বের করে হেসে বলল,তাতো বটেই! তাতো বটেই! ভাই যদি কিছু না মনে করেন,তাহলে একটা বিড়ি খাইতাম। কি বললেন! পড়াশুনার মধ্যে বিড়ি। বোঝেন তো ভাই,এই বিড়ি খাওয়ার অভ্যাস এক দিনের না,অনেক দিনের। আর জানেন,এই বিড়ি খাওয়া আমি কার কাছ থেকে শিখেছি? কার কাছ থেকে? আমার দাদুর কাছ থেকে। ভাবটা এমন,এটা তার উত্তরাধিকার সুত্রে পাওয়া। এজন্য,এটা নিয়ে তার বেজায় গর্ব। জানেন,নির্জন ঘরে দাদু আমাকে পাশে বসিয়ে বিড়ি খাওয়ার যখন ট্রেনিং দিত,তখন কাউকে ঘরে ঢুকতে দিত না। একদিন স্বয়ং আমার বাবা ঘরে ঢুকার চেষ্টা করেছিল। দাদু বাবাকে ধমক দিয়ে বলল,তুই এখানে কি চাস? 
কিছু না,দেখতে আসলাম রাজকুমার তোমার কাছে আছে কিনা। 
যা,যা তোর কোন ভয় নেই। ও আমার কাছেই আছে। তুই এবার যেতে পারিস। সেদিন বাবা আর কোন কথা না বলে ধীরে ধীরে মাথা নীচু করে ঐ বারান্দা থেকে নিজ ঘরে ফিরে চলে গেল। তারপর দাদু আর আমি এক সাথে খট্খট্ করে হেসেছিলাম অনেকক্ষণ। পরবর্তীতে,দাদু আমাকে কাছে বসিয়ে বিড়ি খাওয়ার বিভিন্ন ষ্টাইল শিখায়েছিল। একবার একটানে ধোঁয়াটা নেওয়া,আবার নাকের দুই ফুটার মাঝ দিয়ে কিভাবে ধোঁয়াটা ছাড়তে হয়। আবার,ধোঁয়াগুলি গোল গোল কুন্ডিলি পাকিয়ে শূন্য ছাড়তে কিভাবে তারও ট্রেনিং দিয়েছিল। তবে,ভাই মনে রাখবেন এগুলি অত সহজ নয়! ঐ যে বললাম,নাক দিয়ে ধোঁয়া ছাড়ার কৌশলটা, শিখতে আমার পাকা দুই মাস লেগেছিল। আর ধোঁয়া গোল গোল করে কুন্ডিলি পাকিয়ে ছাড়ার কৌশলটা লেগেছিল তিন মাস। যেদিন আমার দুইটা ট্রেনিং শেষ হয়েছিল,সেদিন সে আমাকে জড়িয়ে ধরে চিৎকার করে বলেছিল,এই তো আমার যোগ্য নাতি! আমাকে উপহার সরূপ এক প্যাকেট গোল্ডলিফ সিগারেটও দিয়েছিল। আমি আমার উপহারটি হাতে পেয়ে দাদুকে বলি,দাদু এই উপহারটি মাকে একটু দেখিয়ে নিয়ে আসি। দাদু ভয়ে চমকে উঠে বলল,খবরদার! এই কাজটি কখনও ভুলেও করিস না। কেন,এটা করলে কি হয়? এটা করলে তোকে আর আমাকে তোর মা এক দড়িতে বেঁধে রাখবে মোটা ঐ জাম গাছের সাথে। তাহলে তো ভালই হবে। কেন? কেন,আবার। তুমি আসলে কিছুই বুঝ না। মা যদি এই কাজটি করে তাহলে,আমার আর ঐদিন স্কুলে যাওয়া লাগবে না। বুঝতো স্কুলে স্যারের বেতের মারের থেকে গাছে বেঁধে রাখা অনেক ভাল। মাঝে মাঝে যদি পাখিরা দুই-একটা করে জাম ফেলে। তাহলে,আমি আর তুমি উঠিয়ে তা মজা করে খেতে পারবো। দাদু পড়ল এবার ভিষণ বিপদে আমার হাতে সিগারেট দিয়ে। তারপর,দাদু সিগারেটের প্যাকেটটি কেড়ে নেওয়ার জন্য আমাকে ধরতে গেল। এবার শুরু হল ঘরের ভিতর ছুটাছুটির পালা। দাদু খাটের এ মাথায় যায় তো আমি খাটের ঐ মাথায়। আর দাদু যখন ঐ মাথায় যায় তো আমি এই মাথায়। 
একটা সময় দাদু হাঁপিয়ে উঠে বলল,আমি আর পারছি না দাদু ভাই। তবে শুনে রাখ,তুই যদি তোর মার কাছে এটা দেখাস,তাহলে তোর মা আর তোকে আমার কাছে পাঠাবে না চিরদিনের জন্য। তখন,আমি মুহুর্তের মধ্যে ছুটাছুটি বন্ধ করে দাদুর কাছে গিয়ে ধরা দিলাম। আর সিগারেটের লাল প্যাকেটটিকে তার হাতে তুলে দিলাম। এই নাও দাদু তোমার সিগারেটের প্যাকেট। কেন,কি হল তোর? এগুলি ফেরত দিচ্ছিস কেন? না,আমার তোমার এই লাল প্যাকেটটি আর দরকার নাই। যে জিনিস তোমার আর আমার আসা-যাওয়া বন্ধ করবে,সেই জিনিস দিয়ে আমি করবো? সেদিন দাদু অপলক দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে ছিল। আমি প্রশ্ন করেছিলাম,কি হয়েছে দাদু তোমার? তুমি আমার দিকে এভাবে তাকিয়ে আছো কেন? এমনি! না,আমি তোমাকে ভাল করেই চিনি। তুমি আমাকে এভাবে দেখার নিশ্চয় কোন কারণ আছে। তাহলে শুনবি কারণ,তাহলে শোন। তোর আমার প্রতি এতটা যে টান আছে তা আমি আগে জানতাম না। শোন,ওসব এবার বাদ দিয়ে বল,কবে থেকে আমাকে হুক্কা খাওয়া শিখাচ্ছো? ওরে বাবা! তুই এই অল্প বয়সে হুক্কা খাওয়াও শিখবি? কেন,সব শিখলাম যখন,তখন হুক্কা খাওয়া শিখাবো না কেন? সাথে সাথে কাছে টেনে নিয়ে বগলে সুঁড়সুঁড়ি দিয়ে বলল,নাতি আমার সেয়ানা হয়েছে ভাল। আমি খিলখিল করে হাসতে হাসতে বলি,দাদু আমার কিন্তু বিয়েও দিতে হবে। দাদু আবারও বগলে সুঁড়সুঁড়ি দিয়ে আঞ্চলিক ভাষায় মজা করে বলল,ঐ কতা কতি নেই। কেন কি হয়েছে? সব কথা কতিছো তুমি,আর এই কতা কলি কি হবে তোমার! দেখ,পাশের বাড়ির কুদ্দুস তিনখান বিয়ে করিছে। লোকে বলে সে তিনটে বিয়ে করিছে,এখন নাকি সে আরও একখানা করবে! মরদের মত মরদ দাদু। তোমার পায়ে পড়ি,আমিও মরদ হতে চাই। সে যদি তিনটা পারে,তাহলে আমি কেন একটা বিয়ে করতে পারবো না। বল,তুমি? কি বললি তুই! বিয়ে করবি? তোর মাথা-টাথা কি ঠিক আছে? বিয়ে বললে বিয়ে হয়ে যায় তাই,না? বিয়ে অত সহজ না। বিয়ে করতি হলি বড় হতি হয় প্রথমে। লেখা-পড়া শিখতি হয়,চাকরি করতি হয়,তারপর না-হয় বিয়ে। এসব নিয়ে এখন তোমাকে চিন্তা করতি হবে না। ওসব পরে হবে। জানেন হিমালয় ভাই,এসব কথা আমার বারবার মনে পড়ছে আজ। আমার সেই দাদু আমাকে ছেড়ে পরপারে পাড়ি দিয়েছে বেশ কিছু বছর হল। আর তার সাথে আমার আর দেখা হবে না কোনদিন। কথা হবে না কোনদিন। ফিরেও আসবে না আর কোনদিন। রাজকুমার দাদা এই কথাগুলি বলতে বলতে চোখের কোনে শিশির বিন্দু,বিন্দু পানি দেখা গেল। 
দাদা আপনার চোখে জল। মুছে ফেলুন,পৃথিবীতে কেউ কখনও চিরস্থায়ী হয়ে আসে না। সময় হলে সবাইকে নিজ বাড়িতে ফিরে যেতে হয়। আর জীবনের এই বেঁচে থাকা সময়টুকু হচ্ছে আমার কাছে বড়ই অস্বাভাবিক আর মৃত্যুটাই হল স্বাভাবিক। রাজকুমার দাদা চোখের জল মুছে বলল,ভাই আপনি বড়ই সত্য কথা বলেছেন। আর এর মত সত্য কথা পৃথিবীতে আর একটিও নাই। কিন্তু দাদা,পড়াশুনার মাঝে বাহিরের কোন কথা না বলাই ভাল। আর একটা কথা মনে রাখবেন,আপনার দাদু সিগারেট খাওয়া শিখাক,আর নাই শিখাক,বিষয়টা বড় কথা না। আপনার উচিৎ এই সিগারেটটা যত দ্রুত সম্ভব বর্জন করা। আমি বলবো,শুধু সিগারেট নয়,কোন তামাক জাতীয় দ্রব্য বা মাদকাশক্ত কোন কিছু না খাওয়াই উচিৎ। দাদা নিশ্চুপ হয়ে কথাগুলি শুনে বলল,ভাই আপনার কথা আমি মেনে চলার চেষ্টা করবো। তবে,এটাতো একদিনে সম্ভব নয়! ঠিক আছে,আপনাকে আমি একদিনে ছাড়তে বলতেছি না। আপনি আস্তে আস্তে এটা ছেড়ে দিন। তবে,এটা যত দ্রুুত ছাড়তে পারবেন,ততই আপনার জন্য মঙ্গল। হঠাৎ,কি মনে করে দাদা আবার দাঁত বের করে বলল,দাদা জীবনে আর বাঁচবো কতদিন! সবারই তো একদিন চলে যেতে হবে এই পৃথিবী থেকে। তাহলে,জীবনের উপর এত মায়া কিসের? আপনি বলেছেন,আমি মাথায় রাখবো আপনার কথাটা। তবে,একটু খারাপ লাগছে এই ভেবে যে,দাদুর দেওয়া স্মৃুতিটাকে নষ্ট করে ফেলবো। 

তন্ময় সকালে উঠে তার আম্মুর কাছে বায়না ধরল আব্বুর কাছে যাব। আছে তো বাবা। কই? অনন্যা দেখল,এতো দেখছি ভারি বিপদ! এখন কোথা থেকে তার আব্বুকে আনা যায়। তবে,এর মধ্যে হিমালয় অনন্যাকে জানিয়ে দিয়েছে সে আগামি সপ্তাহে যশোর আসছে। খবরটা শুনার পর থেকে অনন্যার চোখে আর ঘুম নাই। তাই,অযথা আর ছেলেকে ঢাকায় গিয়েছে মিথ্যা কথাটা না বলে বলল,তোমার আব্বু শুক্রবারে বাড়িতে আসছে। তন্ময় কথাটি রিপিট করে বলল,ভাঙ্গা,ভাঙ্গা গলায় শু-ক্র-বা-র? অনন্যা হেসে বলল,হ্যাঁ শুক্রবার এসে তোমাকে নিয়ে ঘুরতে যাবে। এসে তোমাকে অনেক খেলনার জিনিস কিনে দিবে। খেলনা! তন্ময় একটু দাঁত মেলে হাসল। আম্মু মিত্তি,মানে আব্বু মিষ্টি কিনে দিবে তো? হ্যাঁ,বাবা তোমাকে মিষ্টিও কিনে দিবে। গায়,মানে গাড়ি কিনে দিবে কিনা। হ্যাঁ,তোমাকে গাড়িও দেওয়া হবে। আম্মু কার্টুন। মানে এখন সে টিভিতে কার্টুন দেখবে। কার্টুন দেওয়ার পর দুধ চাইল খেতে,একটা কার্টুন দেখতে দেখতে আর দুধ খাইতে খাইতে সে ঘুমিয়ে পড়ল। বাকি রইল অনন্যা। তার চোখে ঘুম নাই। অনেকদিন পর হিমালয় আসছে। খবরটা তার মধ্যে এক ধরনের নতুন ভাল লাগা তৈরি হয়েছে। কিন্তু বিষাদও আছে অনেক! তার মধ্যে একটা হল একাকি থাকার যন্ত্রণা। এত বড় বাড়ি কিন্তু কেউ নাই এ বাড়িতে। শাশুড়ি ছিল,কিছুদিন হল সে তার বাপের বাড়িতে বেড়াতে গিয়েছে। তার ইচ্ছা হলে থাকে আর ইচ্ছা না হলে সে চলে যায়। এছাড়া,শ্বশুর মারা যাওয়ার পর থেকে সে স্বাধীন জীবন-যাপনে অভ্যস্থ হয়ে পড়েছে। তাই,অনন্যাকে নীরবে,নিভৃতে একাকি জীবনই কাটাতে হয়। আর থাকার মধ্যে একজন বৃদ্ধা কাজের মহিলা আছে। সে আবার সকালে এসে উঠান ঝাড়– দিয়ে চলে যায়। আবার,সকাল ৯টার দিকে থালা,বাসন মাজতে আসে। তারপর ঐ বড় বাড়িতে সে আর তার পুত্র তন্ময়ের শুরু হয় নির্বাসিত জীবন। 
কিছুদিন আগে বৃষ্টির রাতে পাশের রুমে খুট্খাট্ আওয়াজে অনন্যা ভয় পেয়ে গিয়েছিল। ভয়ে তন্ময়কে জড়িয়ে ধরে চোখ বুজে ছিল। কিন্তু খুট্খাট্ শব্দ বন্ধই হচ্ছিল না। তখন না পেরে ভয়-টয় ত্যাগ করে পাশের ঘরে গিয়ে দেখল,মোটা করে এক অচেনা কালো বিড়াল ঝাঁপ মেরে পাশে পড়ে বেরিয়ে গেল মিউ,মিউ করতে করতে। ভয়ে সেদিন অনন্যা কুঁকড়িয়ে গিয়েছিল। কি করবে তখন সে বুঝতে পারছিল না। পরক্ষণে চিন্তা করল,আমি যদি এমন করি তাহলে তন্ময়ও ভয় পাবে। তাই,তন্ময়কে সাহস দেওয়ার জন্য বলল,এই বিল্লু আমরা এখন তোকে মারবো। এসো,এসো। পাশ থেকে একটা লাঠি বের করে মা-ছেলেতে মিলে তাড়া করল। সাথে সাথে বিড়ালটি দ্রুুত ছুঁটে কোথা থেকে কোথায় পালিয়ে গেল। এত গেল একটা সমস্যার কথা। বাকি আছে আরোও অনেক সমস্যা ও অভিযোগের কথা। যাহা,পৃথিবীর অন্য কাউকে বলাও যায় না,বোঝানো যায় না,শুধুমাত্র হিমালয় ছাড়া। একদিন বৃষ্টির দিনে সময়টা সম্ভবতঃ বিকালে হবে। বাহিরে কি বৃষ্টি! যাকে বলে মুষলধারে বৃষ্টি। এমন সময় হঠাৎ চোখে পড়ল অপূর্ব একটি দৃশ্য। দুটি চড়–ই পাখি পরস্পর পরস্পরকে এমনভাবে আলিঙ্গন করে রেখেছে,যাতে বিল্ডিং এর ভেন্টিলেটার ভেদ করে তাদের গায়ে কোন বৃষ্টির জল না লাগে। তবুও মাঝে মাঝে দেখা যাচ্ছে,প্রচন্ড বাতাসে বৃষ্টির ফোঁটা ফোঁটা পানি তাদের গায়ে লাগছে। কিন্তু পুরুষটি যেভাবে হোক তাকে ভিঁজতে দিতে চাইছে না। ভিঁজলে,সে ভিঁজে যাক,তাতে তার কোন আপত্তি নাই। কিন্তু তার স্ত্রী চড়–ইটি যেন না ভিঁজে। পাখিদের ভিতর ভালবাসা ও পরস্পরের প্রতি প্রবল টান তাকে বিস্মীত করল। সত্যই এটা পৃথিবীর বুকে ভালবাসার একটা বিরল দৃষ্টান্ত। সেদিন কেন জানি বারবার হিমালয়ের কথা মনে পড়ছিল অনন্যার। আজ যদি এই দিনে সে একটু তার পাশে থাকত,তাহলে পৃথিবীর সব সুখ তার হাতের মুঠোই থাকত। চাইতো না আর কোন কিছু। বলা যেত,না বলা অনেক কথা। শুনা যেত সব আবেগ ঘনিভূত সব বাক্য। যে বাক্য,শব্দ শুধু তাকে বুঝানোর জন্য,আলোড়িত করার জন্য সৃষ্টি হয়েছে। কিন্তু হল না। মনের আশা মনের ভিতরেই থেকে গেল। ব্যর্থ চোখ নিয়ে শুধু চেয়ে থাকা। আজ একটু হলেও মনের ভিতর রৌদ্র আলো ঝিকিমিকি করছে। মনটা সাজছে নানা সাজে। কারণ একটা,সেটা হল হিমালয় আসছে তার কাছে। তবে,সেই সুখটা হল ক্ষণিকের। যেহেতু,হিমালয় দুই থেকে তিন দিন না যেতেই,আবার সে রওনা দিবে তার কর্মস্থলে সুদূর তার গৌন্তব্যে। হোক সেটা,তবুও তো একটু হলে তাকে দেখতে পাবে অতিথি পাখিদের মত। 
আচ্ছা,ও তো আসবে কিন্তু কি রান্না করা যায়। ওতো আবার ঘাটকোল শাকটা বেশি পছন্দ করে। কিন্তু আমার তো আবার রাঁধতে গেলে বাধে যত সব বিপত্তি। বিশেষ করে হাতটা চুলকায়। তাই,অনন্যার ঘোর আপত্তি ওটা রাঁধতে। তবুও সে রাঁধবে। কারণ,সব কিছুর উর্দ্ধে তার হিমালয়। এই মুহুর্তে পৃথিবীর সবকিছু তার জন্য সে ত্যাগ করতে পারে। আর সামান্য এতটুকু কষ্ট করতে পারবে না সে ? অবশ্যই আমাকে পারতে হবে। আর একটা কি যেন সে পছন্দ করে। ওহ মনে পড়েছে! গরুর মাংস তার খুব পছন্দের একটা খাদ্য। এছাড়াও বিভিন্ন পছন্দ-অপছন্দের খাবারের তালিকা অনন্যার মনে উঁকি দিতে লাগল।

আমি বাস ষ্টান্ডে এসে দেখলাম যশোরে যাওয়ার একমাত্র বাস ফেম। তাও আবার ছাড়ে  খুব সকালে। কাউন্টারে গিয়ে অনেক অনুনয় বিনয় করে একটি টিকিট জোগাড় করলাম। যথা সময়ে বাস তার গৌন্তব্যর স্থলে যাওয়ার জন্য ছুঁটতে লাগল বিরামহীনভাবে। রাস্তার পাশে ফেলে যাওয়া বিভিন্ন ফসলের ক্ষেত-মাঠ,বাড়ি-ঘর ফেলে সে চলতে শুরু করল। আর আমার মনে জড় হতে লাগল নানা ধরনের প্রশ্ন। আচ্ছা,আমাকে তন্ময় চিনতে পারবে তো। না,আমাকে দেখে কেঁদে ফেলবে। না,আব্বু,আব্বু করে আমাকে জড়িয়ে ধরবে। ওহ! সেই মুহুর্তটা আমাকে ভিষণভাবে আলোড়িত করছে বারবার এখন থেকে। আচ্ছা,অনন্যা বুঝি অনেক অভিমান নিয়ে বসে আছে। মনে হয় আমার সাথে প্রথমে ঠিক মত কথাও বলবে না। মুখ ঘুরিয়ে রাখবে অন্যদিকে। ওর মান ভাঙ্গাতে আমাকে অনেক পরিশ্রমও করতে হতে পারে। বিনিময়ে কিনে দিতে হবে অনেক কিছু। আচ্ছা,ওকে কি কিনে দিয়ে প্রভাবিত করা যায়। সেলোয়ার,কামিজ না কসমেটিকসের কোন উপকরণ। না,না এসব আমি কি ভাবছি,আসলে অনন্যাকে কোন জিনিস-পত্র দিয়ে তাকে প্রভাবিত করা যায় না। কারণ,মুলতঃ কোন বস্তুর প্রতি তার তেমন আকর্ষন নাই। অনেকের বেলায় দেখা যায়,এটা না হলে তার চলবে না,ওটা না হলে তার হবে না। কিন্তু অনন্যার ব্যাপারে বিষয়টি সম্পূর্ন ব্যতিক্রম। আশ্চর্য একটা মেয়ে! তাকে দেখে উপর থেকে কিছুই বোঝা যায় না। হয়ত আমি অনন্যার মত মেয়ে পেয়েছি বলে আজও আমার সংসারটা টিকে আছে,না হলে হয়ত কবে তা বেদনার বালু চরে পরিণত হত। 
দেখতে দেখতে বাসটি মাদারীপুর,গোপালগঞ্জ,বাগেরহাট ফেলে খুলনাতে এসে পৌঁছাল। এখানে এসে বাসের কিছু যাত্রী নামল আর কিছু যাত্রী উঠিয়ে আবারও তার দৌঁড় শুরু করল। অজানা আনন্দ বারবার আমাকে তাড়া করত লাগল। বাসের চাকা যতই দ্রুুত সামনের দিকে গড়াতে লাগল,আমিও ততই আমার ভিতরে উত্তেজিতবোধ করতে লাগলাম। একটা সময় দেখা গেল,আমার চির চেনা শহর যশোরে এসে পৌঁছালাম। বহুদিন পর আসাতে শহরটি কেমন জানি আমার মনে হতে লাগল। রাস্তার পাশে কিছু নতুন দোকানও দেখা যাচ্ছে। পরিচিত কিছু মানুষের সাথে দেখা ও শুভেচ্ছা বিনিময় হল। আমি বাড়ির বাহির পা রেখে বুঝতে পারল তন্ময় আমার জন্য অধির আগ্রহে অপেক্ষা করছে। ভিতর থেকে শুনা যাচ্ছে,তার আম্মুর কাছে সে জিজ্ঞসা করছে,আম্মু আব্বু কই? 
এই তো বাবা এখনই আসবে তোমার আব্বু। আর একটু অপেক্ষা কর। বলতে না বলতে আমি আর আবেগকে ধরে না রাখতে পেরে ঘরের বাহির থেকে ডাক দিলাম আব্বু তন্ময়। তন্ময়ের যেন খরগোশের মত কান খাড়া ছিল। ডাকটি শোনা মাত্রই,মুহুর্তের মধ্যে তার মায়ের কোল থেকে নেমে এক দৌঁড়ে গ্রিলের বাহির থেকে একটা মিষ্টি হাসি দিয়ে আব্বু,আব্বু করে গ্রীলটি ভেঙ্গে ফেলতে চাইল। সে ওর আম্মুকে বলল,আব্বু আই...,আব্বু আই....। মানে,আব্বু এসেছে। আমি ঘরের ভিতরে যাওয়ার সাথে সাথে তন্ময় ঝাঁপ দিয়ে আমার কোলে গেল। গিয়ে অমনি মুখের ডান ও বাম পাশে এক সাথে অনেকগুলি চুমু দিল। সাথে সাথে আমিও। পিতা-পুত্রের এ মিলন বড়ই আনন্দের,বড়ই বিরল এ পৃথিবীতে! আমার চোখে আনন্দের অশ্রু ঝরতে লাগল। এতদিন পরে পুত্রের উষ্ণ ভালবাসা পেয়ে নিজেকে আর ধরে রাখতে পারলাম না। এদিকে,অনন্যা চেষ্টা করছে তন্ময়কে তার বাবার কোল থেকে বিচ্ছেদ করতে,কারণ সে বহু দূর থেকে জার্নি করে এসেছে। এখন তার একটু বিশ্রাম এর দরকার। কিন্তু তন্ময় একবারে নাছোড়বান্দা! খুন স্বীকার তো,আমার কোল থেকে সে নামতে রাজি না। আমি অনন্যাকে বাঁধা দিয়ে বললাম,থাক্ না তুমি ওকে আমার কাছ থেকে কেড়ে নিচ্ছো কেন? 
আহা! তুমি না হাত-মুখ ধোবে? শোন,আগে গোসল করে ফ্রেশ হয়ে নাও,তারপর তোমরা পিতা-পুত্র যা ইচ্ছা তাই করিও,বুঝেছো? তারপর অনেক অনুরোধ করার পর তন্ময় আমার কোল থেকে নামল। তবে,সে তার বাবার পিছু সহজে ছাড়ছে না। তার বাবা যেখানে যায় সেও সেখানে যায়। তার বাবা যখন গোসলখানায় ঢুকেছে,সে তখন বাবার গামছা ও তাওয়ালে নিয়ে বাথরুমের বাহিরে অপেক্ষা করছে। ওদিকে,তার আম্মু শত চেষ্টা করেও বিন্দুমাত্র তাকে সরাতে পারল না। আমি তাকে বলেছি,আব্বু তুমি ঘরে যাও। আমি এক্ষুণি গোসল সেরে আসছি। তার একটাই কথা,বাবাকে নিয়ে সে ঘরে ফিরবেই,ফিরবে। এতে এই মুহুর্তে কারো কোন কথা সে রাখতে পারবে না। অগত্যা,তার আম্মু না পেরে তাকে একা রেখে রাগ করে ঘরের ভিতর চলে গেল। যাওয়ার আগে আমাকে ডাক ছেড়ে বলল,এই তোমার ছেলে কিন্তু বাহিরে বসে আছে। তন্ময় ওর আম্মুর দিকে তাকিয়ে বলল,যা....ও,যা......ও আমি আসছি। 
আচ্ছা,তোমার আব্বুকে পেয়ে তুমি খুব পেঁকে গিয়েছো,তাই,না? দাঁড়াও! তোমার আব্বু আর ক‘দিন। তারপর দেখা যাবে তোমার খেলা! তন্ময় তার আম্মুর কথা শুনে দাঁত বের করে খিলখিলিয়ে হাসতে লাগল। ভাঙ্গা,ভাঙ্গা গলায় তার আব্বুর কাছে অভিযোগের সুরে বলল,আব্বু......,আম্মু..... কি কয়? আমি আমার ছেলের কথা শুনে হেসে উঠলাম। তন্ময় তুমি দুষ্টুমি করনা। যেখানে আছো,চুপ করে বসে থাকো। এরমধ্যে একটা কুকুর এসে বাহিরে দাঁড়িয়ে রইল। যদিও কুকুরটি কিছু দিন হল তন্ময়ের সাথে বেশ ভাব জমেছে। আব্বু......,আব্বু কুকু,কুকু। মানে,আব্বু কুকুর এসেছে। তন্ময় তুমি চুপ করে বসে থাকো। না হলে,কুকুর তোমাকে কামড়িয়ে দিবে। কামি দিবে,দাঁড়া....বলে পাশে পড়ে থাকা একটা ইটের টুকরা তার গায়ে ছুঁড়ে মারল। কুকুরটি না চলে গিয়ে বরং একটু দূরে দাঁড়িয়ে তার লেজ নেড়ে তন্ময়কে অভ্যর্থনা জানাতে লাগল। এরকম দেখে তন্ময়ের খুব হাসি পেল। কি হল আব্বু? আব্বু কুকু লে......। এবার হিমালয় কিছু বুঝলো না। কি বলছো আব্বু? আব্বু কুকু লে...। এমন সময় অনন্যা এসে হাজির হল। তুমি বুঝতেছো না সে কি বলছে? ও বলছে কুকুরে লেজ নাড়াচ্ছে। কেন,কুকুরে লেজ নাড়াচ্ছে কেন? আর বলনা,এই কুকুরটা ক‘দিন হল তোমার ছেলের সাথে ভাল একটা ফেন্ডশিপ তৈরি হয়েছে। সেজন্য,প্রতিদিন কুকুরটির তন্ময়কে দেখতে আসা চাই,চাই। তো কুকুরটি যদি ওকে কামড়িয়ে দেয়? আরে না,না ওসব নিয়ে তোমাকে ভাবতে হবে না। দেখছো না,তন্ময় তাকে ঢিল ছুঁড়ছে আর কুকুরটি পালিয়ে না গিয়ে বরং দূরে দাঁড়িয়ে লেজ নাড়ছে। না,না অতসব ফেন্ডশিপের দরকার নাই। কখন না জানি তাকে কামড়িয়ে দিবে সে। তুমি বরং কুকুরটিকে তাড়িয়ে দাও। ভালই বলেছো,আমি যদি এখন ওকে তাড়িয়ে দি। তাহলে তোমার ছেলেকে তুমি আর ধরে রাখতে পরবে? কেন,কি হবে? কি হবে,এক্ষুণি সে মাটিতে শুয়ে গড়াগাড়ি খাবে। এর মধ্যে কথা বলতে বলতে আমার গোসল শেষ হয়ে গেল। বাথরুমের দরজা খুলে দেখি,যেভাবে আমি ছেলেকে বসে থাকতে দেখেছিলাম,ঠিক সে সেইভাবে বসে আছে লুঙ্গি ও গামছা হাতে নিয়ে। এর মধ্যে তার আম্মু অনেকবার চেষ্টা করেছে ছেলের হাত থেকে এগুলি নিতে। কিন্তু বারবার সে ব্যর্থ হয়েছে নিতে। তন্ময় তার বাবাকে দরজা খুলার সাথে সাথে লুঙ্গি-গামছা এগিয়ে দিল তার দিকে। আমি পুরা অবাক আমার ছেলের কান্ড-কারখানা দেখে! সে তার বাবাকে দাঁত বের করে বলল,বাবা কুকু। তার মানে,কুকুর বন্ধুর সাথে তার বাবাকে পরিচয় ঘটিয়ে দিতে চাচ্ছে। কুকুরটিও পা দুটি উঁচু করে বন্ধুর বাবাকে সংবর্ধনা জানাল।
কখন ভোরের আলো উঠে নাচানাচি শুরু করে দিয়েছে,তা হিমালয় ও অনন্যা যুগল দম্পত্তি জানে না আজ। কারণ,বহুদিন পর পরস্পরের জমানো কথা বলতে বলতে অনেক রাত জেগে ঘুমিয়েছে তারা। ঠিক যেমন বাসর রাতে স্বামী-স্ত্রী বেলায় ঘটে। এটা যেন দ্বিতীয়বার বিয়ে না করেও পুনরায় বিয়ের স্বাদ গ্রহন করা। ওদিকে,অনন্যার শাশুড়ি সকাল হতে না হতে ডাকাডাকি শুরু করে দিয়েছে অনন্যাকে। কারণ,বহুদিন পর তার ছেলে বাড়িতে এসেছে। একটু ভাল-মন্দ খাবার তাকে পরিবেশন করতে হবে। বৌমা,বৌমা। অনন্যা ঘুমের আড়মোড়া ভেঙ্গে তাড়াতাড়ি নিজেকে গুছিয়ে নিয়ে বলল,জিঁ আম্মা আসাছি। একটু তাড়াতাড়ি এদিকে  এসো। হিমালয়ের জন্য নাস্তা-পানির কিছু একটা ব্যবস্থা তো করতে হবে। জিঁ আম্মা। আপনি যান,আমি এক্ষুণি আসছি। যেই,সে বিছানা ছেড়ে উঠতে যাবে,সেই তার ডান হাত টেনে ধরে বললাম আর একটু পরে গেলে হয়না? না,না আর সম্ভবই না। আর একটু যদি দেরি করি,তাহলে তোমার মা চিল্লা-পাল্লা করে বাড়ি, ঘর-দুয়ার মাথায় তুলবে। তখন পরিস্থিতি সামলানো খুব কঠিন হবে,তার চেয়ে বরং এক্ষুণি যাওয়ায় ভাল। বলে অমনি দ্রুত সে ঘর ছেড়ে চলে গিয়ে রান্না ঘরের কাজে যোগ দিল। এদিকে,তন্ময় এখনও ঘুমে অচেতন। সে আজ তার বাবাকে পেয়ে আনন্দে-উল্লাসে আত্মহারা। তাই,রাতে আজ মায়ের বুকে না ঘুমিয়ে বাবার বুকে সুখের ঘুম ঘুমিয়েছে। আমি আলতো করে ঘুমান্ত অবস্থায় ছেলের কপালে চুমু দিলাম। সাথে সাথে সে ঘুম থেকে চোখ খুলে মুচকি হাসি দিল। এবার সে চোখ দুটি এদিক-ওদিক ঘুরিয়ে বিছানা ছেড়ে উঠে বলল,আব্বু ঘোড়া,ঘোড়া। মানে,তার আব্বুকে এখন ঘোড়া হতে হবে সাথে সাথে আমি ঘোড়ার মত হি,হি শব্দ করে তাকে পিঠের সাওয়ারি করার জন্য প্রস্তুত হলাম। তন্ময় আর কোন কালক্ষেপন না করে চুপ করে ঘোড়ার পিঠে উঠে বসল। বসেই অমনি,চলো ঘোড়া,চলো। আমিও বিছানার এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে হিঁ,হিঁ শব্দ করে ঘুরতে লাগলাম আর উপরে উঠে বসা তন্ময় বেশ মজা করে অনেকদিন পর আনন্দ পেতে লাগল। 
পাশের রুম থেকে মা ডাক ছেড়ে বলল,কিরে হিমালয় তুই এতদিন পর বাড়িতে এসে হিঁ,হিঁ করছিস কেন? তুই বাহিরে থেকে একি বদ অভ্যাস শিখে এসেছিস? ওদিকে আবার হিঁ,হিঁ শব্দ বন্ধ করলে তন্ময় কান্নাকাটি শুরু করে দিচ্ছে। আমি পড়েছি এক মহা ঝামেলায়! সুতারং,আমার ইচ্ছা না থাকলেও হিঁ,হিঁ শব্দ করে ঘোড়ার ডাক দিতে হচ্ছে। ওদিকে,মা অনন্যাকে ডেকে বলল,কি ব্যাপার ঐ ঘরে হিমালয় হিঁ,হিঁ করছে কেন,দেখতো। আমার তো বৌমা বেশি ভাল লাগছে না ব্যাপারখানা। তুমি বরং এখন রান্না ঘরের কাজ রেখে ঐ ঘরে একটু যাও দেখি। আচ্ছা মা,আমি যাচ্ছি। আপনি অস্থির হবেন না। অনন্যা গিয়ে দেখে বাপ-বেটা ঘোড়া,ঘোড়া খেলা খেলছে। ও তাহলে এই ব্যাপার! ওদিকে মা ভাবছে,তোমার কোন সমস্যা হয়েছে,না হলে ঘোড়ার মত ডাকবে কেন? তা নাই হল,কিন্তু এখন মার কাছে গিয়ে কি রিপোর্ট দিবে তুমি? কি রিপোর্ট দিবো যা সত্য তাই বলবো। বলবো,আপনার ছেলে ও নাতি মিলে ঘোড়া ঘোড়া  খেলা খেলছে। খবরদার! একথা তুমি বলবে না। তুমি বলবে গিয়ে কই সবইতো দেখছি ঠিক আছে। ঠিক আছে জনাব,আপনি যেটা বলবেন আমি সেটাই অক্ষরে অক্ষরে পালন করবো। কিন্তু পরবর্তীতে সমস্যা হলে আমি কিছু জানি না। অনন্যা এ ঘর থেকে ফিরে আসার পর তার শাশুড়ি জিজ্ঞাসা করল,কি হয়েছে হিমালয়ের? ওসব কিছুনা মা। কিছুনা বললে হল। আমি স্পষ্ঠ কানে শুনলাম পাগলের মত সে হিঁ,হিঁ করে শব্দ করছে আর তুমি বলছো কিছু না। তাহলে,আমি ভুল শুনলাম। শোন,আমার একটু বয়স হতে পারে কিন্তু শ্রবণ শক্তি আমার অতটা কমে যায়নি। আচ্ছা,তুমি কি আসলে ঐ ঘর থেকে এসেছো? 
জিঁ আম্মা, বললাম তো এসব নিয়ে আপনাকে চিন্তা করতে হবে না। না,আমার তো একটু সন্দেহ হচ্ছে। দেখি,আমি নিজে যাই। এবার ঘরের বাহিরে দাঁড়িয়ে হাম্বা,হাম্বা শব্দ শুনতে পেল। বৌমা, ও বৌমা। জিঁ আম্মা। একবার এদিকে এসো তো দেখি। তোমাদের রুম থেকে এবার অন্য কিছুর শব্দ শুনতে পাচ্ছো? জিঁ মা। এটা কিসের ডাক? সম্ভবত এটা মা গরুর ডাক। একবার ঘোড়া,একবার গরু। তাহলে কি আমার ছেলে পাগল হয়ে গেল নাকি? 
অনন্যা মুচকি হেসে বলল,না,না মা ওসব কিছু না। আপনি রান্না ঘরে যান,আমি আসছি। না,না তুমি বিষয়টাকে এত খাটো করে দেখছো কেন? চলো তো আমরা দু‘জনে দেখি ব্যাপারখানা কি। গিয়ে দেখে,ছেলে বাবাকে ঘোড়া,গরু বানিয়ে খেলছে। মা বলল,তুই আমার ছেলেকে ঘোড়া,গরু বানাচ্ছিস! দাঁড়া,আমি তোকে এবার মজা দেখাচ্ছি। তন্ময়ও ছেড়ে দেওয়ার পাত্র নয়,সেও পিঠে থাকা অবস্থায় তার দাদাীকে মুখ ভেংচি কাটল। দাঁড়া আমি তোর ভেংচি কাটা বের করছি। এতটুকু একটা ছেলের অবস্থা দেখেছো বৌমা! তন্ময় এ ধরনের অভিযোগের কথা শুনে দাঁত বের করে হাসতে লাগল। 

দেখতে দেখতে অফিসের ছুটি দ্বার প্রান্তে এসে পৌঁছাল। আগামিকাল বিকালেই তার বাস। অগ্রিম টিকিটও কেটে ফেলেছে হিমালয়। মাঝে আছে শুধু একটি দিন,কয়েক ঘন্টা,মিনিট ও সেকেন্ড। হিমালয় চাইছে ¯্রষ্টা যদি এখন থেকে ঘড়ির কাঁটাগুলি সব স্থির করে দিত। স্থির করে দিত,পৃথিবীর মানুষের সময় সম্পর্কে সচেতনতা বোধ। কিন্তু সেটা ছিল কল্পনা মাত্র,বাস্তবে তা ছিল খুবই কঠিন। তন্ময়ের হাস্য উজ্জ্বল মুখ আর কিছুক্ষণ পর মলিনে পরিণত হবে। মলিনে পরিণত হবে তার স্ত্রীরও। আর সেই ব্যথা নিয়ে তাকে ত্যাগ করতে হবে যশোর। 
অনন্যা কাছে এসে বসল,কি হয়েছে তোমার? তুমি এত গভীরভাবে কি ভাবছো? তেমন কিছুনা। তুমি বললে হবে তেমন কিছুই না। আমি তোমার মুখ দেখলে স্পষ্ঠ বুঝতে পারি,তোমার কি হয়েছে। সত্যই তাই? জিঁ,জনাব সত্যই তাই। এতটা বছর কাছে থেকে যদি তোমাকে এতটুকু না চিনতে পারলাম,তাহলে হলটা কি? বাহ! তুমি তো দেখছি,আমাকে নিয়ে গবেষণা করতে করতে মস্ত বড় একটা বই লিখেতে পারবে এখন। তা তুমি কথাটা একেবারে খারাপ বলোনি। তাহলে বলতো আমি এখন কি ভাবছি? তুমি কি ভাবছো? এটাতো একেবারে সহজ একটা ব্যাপার। তুমি এখন তন্ময় ও আমাকে নিয়ে ভাবছো যে,তুমি চলে গেলে আমাদের মন খারাপ হবে কিনা,ইত্যাদি। শোন,অত সব ভেবে-চিন্তে লাভ নেই। আমাদেরকে নিয়ে তোমার অত বেশি চিন্তা করতে হবে না। আমরা দু‘জনই ভালই থাকবো। খারাপ যে লাগবে না,সেটা একেবারই সত্য নয়। কিন্তু কি করার আছে বল! 
আমি মনে মনে দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছেড়ে উদাস হয়ে বললাম,হ্যাঁ আমারও খারাপ লাগবে। কিন্তু বাস্তবতার মূল্য দিতে গিয়ে ত্যাগ করতে হচ্ছে দিনের পর দিন স্ত্রীর ভালবাসা,সন্তানের ভালবাসা,বন্ধু-বান্ধবের ভালবাসা আরোও কত ¯েœহ,মায়া-মমতার প্রবল ঢেউ। জানিনা,আর কতটা সময় পার হলে এসব কষ্টের অবসান হবে। জানো,আজকাল মাঝে মাঝে স্বপ্ন দেখি,তন্ময় আমাকে ডাকতে ডাকতে মেইন রাস্তা পর্যন্ত পৌঁছিয়ে গিয়েছে। তার ধারনা,এই রাস্তার মাথায় আসলে তাঁর বাবা,তাঁর ডাকের সাড়া দিবে। আর তখন দেখি,মেইন রোডের বড় বড় যান-বহনের হুইসাল ও চাকার শব্দে মিলিয়ে যায় তার সব প্রবল আকুতিগুলি। অবশেষে,প্রতিদানে তার জোটে তিরস্কার। কারণ,সে রাস্তায় আসার অপরাধে তাকে তোমার কাছে,নয়তো তার দাদীর কাছে,নয়তো তার চাচার কাছে বকুনি শুনতে হচ্ছে। কিন্তু কেউ বোঝে না ছোট্র শিশুর প্রাণের কথা। হয়ত যদি তুমি হৃদয় দিয়ে তার চোখের দিকে তাকাতে, তাহলে বুঝতে পিতার জন্য পুত্রের কি টান! থাক,বুঝেছি তোমার কথা। তাহলে তুমি বুঝাতে চাইছো আমার কোন টান নাই তন্ময়ের প্রতি। টান যা আছে সব তোমারই আছে। দেখো,স্বপ্ন,স্বপ্নই আর বাস্তব,বাস্তবই। দুটির ভিতর আকাশ-পাতাল ব্যবধান। শোন,তোমার চেয়ে ওকে আমি কম ভালবাসি না। আহা! অনন্যা আমি তা বলছি না। আমি আমার স্বপ্নের কথাটা শুধু তোমাকে বললাম। আচ্ছা যাক,তোমাকে আর অত স্বপ্ন দেখতে হবে  না। তোমরা এখন বাপ-বেটা দু‘জনে বসো আমি তোমাদের জন্য দুপুরের খাবার নিয়ে আসি। আম্মু লুস খাবো। দেখছো তোমার ছেলের কান্ড? কেন কি হল আবার? কেন,তুমি বুঝ না? তোমার ছেলে কি খাইতে চাচ্ছে? হ্যাঁ,সে এখন লুডুস খেতে চাইছে,তাতে সমস্যা কোথায়? কেন,ঘরে কি তোমার লুডুস নাই? থাকবে না কেন? তাহলে এক্ষুণি আমার ছেলের জন্য লুডুস রান্না করে নিয়ে এসো। বাহ! যাকে বলে “বাপকা বেটা,কুছ নেহি কা থোরা থোরা”। ছেলে যেই বলল লুস খাবো,উনিও তার সাথে গলা মিলিয়ে বলল,লুস নিয়ে আসো। আচ্ছা,তোমার কি এখনও হুস আছে যে,এখনও আমি গোসলটি পর্যন্ত করিনি আর তুমি বলছো কিনা লুডুস রান্না করে আনো। আচ্ছা শোন আব্বু,তোমাকে আমি বিকালে লুস খাওয়াবো। এখন তোমার আব্বুর সাথে বসে মাছ দিয়ে ভাত খাও। তন্ময়ের মুখে আর কোন কথা নাই। তার মুখ দেখে স্পষ্ঠ বুঝা যাচ্ছে সে ভিষণভাবে ক্ষেপে আছে। 
আমি বিষয়টা বুঝতে পেরে তন্ময়কে কোলে নিয়ে বসিয়ে বললাম,আব্বু তোমাকে আমি বিকালে জুস কিনে দিবো,তুমি যদি এখন ভাত খাও। সাথে সাথে সে দাঁতগুলি বের করে হাসি দিল। অনন্যা তুমি যাও,এক্ষুিণ আমাদের জন্য ভাত নিয়ে এসো। 

আর একটু পরে আমাকে বের হতে হবে কর্মস্থলের উদ্দেশ্য। ইতিমধ্যে প্রয়োজনীয় জিনিস-পত্র আগেই অনন্যা গুছিয়ে রেখেছে। যাওয়ার সময় তন্ময়ের কষ্ট হবে বলে,আগেই আমি তাকে আদর-সোহাগ দিয়ে ঘুম পড়িয়ে রেখেছি,কারণ সে জেগে থাকলে আমার পক্ষে যশোর ছাড়া খুব কষ্টকর একটা বিষয় হয়ে দাঁড়াবে। বাড়ি ছেড়ে যাওয়ার সময় ঘুমান্ত ছেলের দিকে সজল নয়নে তাকালাম একবার,আমি জানি আর একটু পরে আমার ছেলে উঠে গিয়ে আব্বু,আব্বু বলে কান্নাকাটি শুরু করে দিবে। তাকে সামলানো অনন্যার কাছে খুব কঠিন হবে। হয়ত একটা সময় তাকে আঘাত করতে বাধ্য হবে। কিন্তু অবুঝ ছেলের মনের আকুতি উথাল-পাতাল করা আবেগের ঢেউ আছড়ে পড়বে তার হৃদয় উপকুলে। তখন হয়ত সে কষ্ট ভরা হৃদয় নিয়ে তার আম্মুকে প্রশ্ন করবে আম্মু,আব্বু কি ঢাকায়? অর্থ্যাৎ,আব্বু দূরে কোথাও গিয়েছে কিনা। তার আম্মুও আব্বু ঢাকায় বলে তাকে বুঝিয়ে রাখবে। আমি সামনের দিকে পা বাড়াচ্ছি আর পিছন দিকে ফিরে ফিরে তাকিয়ে দেখছি তন্ময়কে। অনন্যা ধমকের সুরে বলল,তুমি কি করছো এটা? তোমার যদি বেশি খারাপ লাগে,তাহলে আরোও কিছুদিন বাড়িতে থেকে যাও। না,না সেটা সম্ভব নয়। তাছাড়া,ওদিকে বাসের টিকিটও কেটে ফেলেছি। অনন্যার মুখে কোন কথা নাই,নাই আমার মুখেও। তবে,অনন্যা কি যেন বলতে গিয়ে থেমে গেল। আমি আর কোন কথা না বাড়িয়ে সামনের দিকে পা বাড়ালাম। 
শরীয়তপুরে ফেম বাসটি যখন থামল,তখন বেলা ৬.৩০ মিনিট বাজে। হালকা গুড়ি,গুড়ি বৃষ্টিও হচ্ছিল। বৃষ্টি মাথায় নিয়ে মেসে পৌঁছালাম। কিন্তু মেসের ভিতর বাতি নেভানো। কারোও কোন সাড়া শব্দ নাই। ঘরে ঢুকে দেখি জাকির আর পাশের রুমের সেই ঐতিহাসিক দাদা নাক ডেকে ঘুমিয়ে চলেছে। আমার পায়ের শব্দ পেয়ে জাকির নামে ছেলেটি উঠে বসে জিজ্ঞাসা করল,ভাই কখন আসছেন? এইতো,এইমাত্র আসছি। তো ভাই,বাড়ির সবাই ভাল আছে তো? হ্যাঁ। হঠাৎ,ওপাশের রুম থেকে দাদা চিৎকার করে বলে উঠল,ও ভাই কেমন আছেন? বলে এ ঘরে ছুঁটে আসল। মূহুর্তের মধ্যে আমার চোখে পড়ল দাদা তার দাঁতগুলি বের করে দিয়ে আমার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। কি ভাই,আপনি আমাদের জন্য কি আনছেন বাড়ি থেকে? ঐ যে আপনার প্রিয় পিঠা কুলি পিঠা নিয়ে আসছি। কিন্তু আমার যে কুলি পিঠা খুব পছন্দের তা আপনি বুঝলেন কি করে? কেন,আমি বাড়ি যাওয়ার আগে বলেছিলেন না আপনার সবচেয়ে প্রিয় পিঠা কুলি পিঠা। ওহ! মনে পড়েছে এবার। ভাইয়ের আসলেই স্মরণ শক্তি প্রখর। কই দেখি তো,আমার যে আর তর সইছ না। আমি পিঠের পুটলিটা তার সামনে মেলে ধরার সাথে সাথে কপাকপ্ গিলতে লাগল। আহারে ভাই! আপনার পিঠার তুলনা হয়না। কে বানিয়েছে ভাই? কে আর বানাবে,আপনার ভাবি বানিয়েছে। তাই,তো বলি এমন পিঠা ভাবি ছাড়া আর কে বানাতে পারে? যা বলেন ভাই,ভাবির গুন আছে বটে! এখন থেকে তো ভাই আপনার একটা কাজ বেড়ে গেল। কি সেটা? কি আর ঐ যখনই বাাড়িতে যাবেন,তখনই কিন্তু আমাদের জন্য আপনাকে এই পিঠা আনতে হবে। সে না হয় হল দাদা,কিন্তু আপনার যে চুসি পিঠা খাওয়ানো কথা ছিল। দাদা আপনার পিঠার নামটা না বেশ ব্যতিক্রম। নাম শুনলে মনে হয় জিহ্বার পানি এসে যায়। মনে হয় এখন থেকেই চুসা শুরু করি। কথাটা শুনামাত্র দাদার পিঠা খাওয়ার গতি কিছুটা হলেও কমে গেল। এবং মুখ দেখে কিছুটা হলেও বুঝা গেল,কথাটিতে বেশি সে সন্তুষ্ট হতে পারে নাই। কি দাদা,কিছু যে বলছেন না? না,না কি বলবো,আপনার এ পিঠা খেয়ে পৃথিবীর সব কিছু আজ ভুলে গিয়েছি,যেন লাখে একটা। আমি স্পষ্ঠ বুঝতে পারলাম,দাদা এই মুহুর্তে বিষয়টি এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে। দাদা এসব জিনিস ভুলে গেলে তো চলবে না। আপনাদের রাজবাড়িতে চুসি পিঠাটি খুব চলে,তাই না? হ্যাঁ,ভাই আপনি ঠিকই বলেছেন। কিন্তু ভাই এই পিঠার তো সিজন আছে। এটা যখন তখন হয়না। কেন? এর সমস্যা কি? না মানে,ঋতুর সাথে যদি তাল মিলিয়ে আমরা কাজ-কর্ম না করি,তাহলে ক্ষতির সম্ভবনা বেশি থাকে। এটা হচ্ছে শাস্ত্রের বিধান! বোঝেন তো,শাস্ত্রের বিধান উপেক্ষা করা ঠিক হবে না। হাজার হলেও আমি একজন ব্রাম্মনের ছেলে। আপনি যেমন আপনার বিধান কে অমান্য করতে পারেন না,তেমনি আমি। আহা দাদা! কথা হচ্ছে আপনি আমাকে আপনার এলাকার নাম করা চুসি পিঠা খাওয়াবেন কিনা? সেখানে শাস্ত্র আসছে কেন? দাদা একটু উদাস হয়ে বলল,আছে ভাই,আছে। আপনি হয়ত এটা এখন বুঝবেন না,পরে আপনি ঠিকই বুঝবেন। আপনি এ ব্যাপারে আপনার আম্মার সাথে কথা বলে দেখবেন। আমি নিশ্চিত এ বিষয়ে একটা সঠিক উত্তর আপনি পেয়ে যাবেন। দেখুন,আপনি যাহাই বলুন না কেন,আমাকে আপনার এলাকার চুসি পিঠা চাই,চাই। এখন আপনি কোথা থেকে এনে দিবেন,সেটা আমি জানি না। 

সকালে উঠে আবারও হিমালয় অফিসের দিকে ছুঁটা শুরু করল। অফিসে গিয়েই জানতে পারল লিয়াকাত সাহেব এর আর এ অফিসে থাকা হচ্ছে না। তাকে মাদারিপুরে ট্রান্সফার করা হয়েছে। লিয়াকত এর রুমে ঢুকেই আমার চোখে পড়ল তার বিষন্ন মুখটা। কি ব্যাপার লিয়াকত ভাই,আপনি এমন মুখ গুমড়া করে বসে আছেন কেন? দুর ভাই! আর বলেন না। হেড অফিস থেকে চিঠি আসছে আমাকে মাদারিপুর যেতে হবে। বললেই হল,যেন মামা বাড়ির আবদার! আপনি একটু ভাবতে পারেন কি অন্যায়টা না আমার সাথে করা হয়েছে! এই ক‘দিন হল আপনার ভাবিকে অনেক কষ্ট করে শরীয়তপুর সদরে বদলি করিয়েছি। এই কাজ করতে গিয়ে মন্ত্রী,আমলা কত জনের কাছেই না আমার যেতে হয়েছে। তবেই না ট্রান্সফার! তারপর ধরুন,বাসা পাল্টানো বাদেও কত কি ঝামেলা। আমি বিষয়টা বুঝতে পেরে লোকটির প্রতি আমার ভারি মায়া হল। কি আর করবেন ভাই,কপালে যেটা আছে,সেটা আপনাকে মেনে নিতেই হবে। তাছাড়া,এই মুহুর্তে তো এই অর্ডার রদ-বদল করা সম্ভব নয়। সাথে সাথে লিয়াকত সাহেব হুংকার দিয়ে উঠে বলল,কে বলেছে যে এটা সম্ভব নয়? আপনি জেনে রাখুন,আমিও বসে নেই। বড় স্যারদের সাথে আমার কথা হয়ে গিয়েছে। তারা আমাকে বলেছে যে,যান আপনি আপনার অফিসে। এই ব্যাপারে আপনার কোন সমস্যা নাই। এই দেখুন,আমি আবার বসলাম আমার চেয়ারে,দেখি কোন শালায় আমারে এখান থেকে উঠায়। এমন সময় হঠাৎ,অপরিচিত এক ভদ্রলোক দরজার গোড়ায় এসে হাজির। আমি তাকে জিজ্ঞাসা করলাম,ভাই আপনি কাকে চান? না,মানে আমি ফরিদপুর অফিস থেকে বদলি হয়ে এসেছি এখানে। আমার নাম আলী আহম্মেদ। নামটি শুনার সাথে সাথে লিয়াকত ভাইয়ের মুখটা কেমন জানি চুপসে গেল। তার মুখে আর কোন কথা নেই। এতক্ষণ যে হামকি-ধামকি করছিল মুহুর্তে সব শেষ হয়ে গেল। ভাই আপনি ভিতরে এসে বসুন। লোকটি বেশ ভাবের সহিত চেয়ারটি টেনে নিয়ে বসল। এরমধ্যে পাশের রুম থেকে ইয়াদ হোসেন এসে বলল,ইনি আমাদের নতুন একাউন্টস ইনচার্জ ও ফোর ইনচার্জ। পদবী এস.ও। আমরা সবাই তাকে শ্রদ্ধার চোখে দেখতে লাগলাম। কারণ,এস.ও মানে সে আমাদের পদ মর্যদায় একটু বড়। তাছাড়া,লিয়াকত সাহেব এর পদ থেকে দুই ধাপ উপরে। সমস্যা আরোও বেড়ে গেল লিয়াকত সাহেব এর। অগত্যা,উপায়-অন্তর না দেখে লিয়াকত সাহেব চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে তাকে চেয়ারটিতে বসতে অনুরোধ করল এবং নিজেই অন্য চেয়ারে গিয়ে বসল। লিয়াকত সাহেব হাসতে হাসতে বলল,আপনার পথে আসতে তেমন কোন সমস্যা হয়নি  তো? তিনি খুব গম্ভীরভাবে উত্তর দিল,না। আচ্ছা আপনি না লিয়াকত সাহেব? জিঁ। কিন্তু আমি যতদূর জানি,আপনি তো মাদারিপুর ট্রান্সফার হয়েছেন,তাই না? হয়েছি। কিন্তু এখনও যাননি কেন? না,তেমন কোন কারণ নাই। তবে,হেড অফিস বলেছে যে,আপনি আপনার অফিসে অফিস করুন,সময় মত আপনার বদলি বাতিল করা হবে। আপনি কি মনে করেন আসলে এটা এত দ্রুত সম্ভব? কেন সম্ভব নয়,যেহেতু হেড অফিস বলেছে। হুম,আচ্ছা ঠিক আছে আপনি এখানে অফিস করুন। কিন্তু দেখবেন,মাদারিপুর অফিস যেন আপনাকে অনউপস্থিত না করে আর বেতন দেওয়াতে যেন কোন প্রকার সমস্যা না হয়। লিয়াকত সাহেব তাচ্ছিল্যর হাসি হেসে বলল,না না ওসব নিয়ে আমি একদমই ভাবছি না। দেখুন,কোন সমস্যা না হলে তো খুব ভাল। 
বর্তমানে,একই রুমে পাতা অন্য একটি চেয়ার-টেবিলে বসে লিয়াকত সাহেব অফিস করছে,আর আলী আহমেদ সাহেব লিয়াকত সাহেব পূর্বের জায়গায়। মাঝে মাঝে তারা পরস্পর পরস্পরের প্রতি পিট্পিট্ করে তাকায় ও হাসে। কিন্তু লিয়াকতের মনে আছে ক্ষোভ ও কষ্ট। সে প্রতিদিন হেড অফিসের দিকে তাকিয়ে থাকে কখন তার বদলি স্থগিতের চিঠি আসবে। ইতিমধ্যে,তার মোবাইলে অনেক টাকাও ব্যয় হয়ে গিয়েছে এই উদ্দেশ্যে। কিন্তু কোন চিঠি আসে না। তারপর,আরোও কিছুদিন পার হয়ে গেল তবুও হেড অফিস নীরব। ক্রমে,ক্রমে লিয়াকতের দুঃচিন্তা বাড়তে লাগল। এদিকে,মাদারিপুর অফিসও তাকে এ্যাবসেন্ট হিসাবে দেখাতে লাগল। কিন্তু তার দৃঢ় বিশ্বাস এসব সমস্যা তার কাছে কোন সমস্যাই না। কিন্তু একটা সময় যখন দেখল,হেড অফিস তার জন্য আর কোন কিছু করছে না,তখন সে বাধ্য হয়ে আমার স্মরণাপন্ন হল। ভাই এখন আমি কি করবো? দেখুন লিয়াকত সাহেব,আমি যতদূর জানি একবার ট্রান্সফার হয়ে গেলে অত সহজে ট্রান্সফার রোধ করা যায় না। আপনি আপাতত মাদারিপুরে জয়েন্ট করেন। পরবর্তীতে,দেখেন যোগাযোগ করে কিছু একটা করা যায় কিনা। তাছাড়া,আমার কিন্তু একটা বিষয় নিয়ে খুব দুঃচিন্তা হচ্ছে। সেটা কি? সেটা হচ্ছে,আপনি এ মাসের বেতন পাবেন কিনা। হ্যাঁ ভাই,এখন আমিও এই বিষয় নিয়ে ভাবছি। তবে কি জানেন,আমি যদি এখন চলে যায় তাহলে,বেশ কিছু প্রাইভেট পড়াতাম,এগুলি আমার হাত ছাড়া হয়ে যাবে। তাছাড়া,আমার এন.জি.ও প্রতিষ্ঠানটিও ধ্বংসের মুখে পড়বে। এতদিন পরে বেরিয়ে এলো তার থলের বিড়াল! আচ্ছা,আপনার তো তাহলে একটা এন.জি.ও প্রতিষ্ঠানও আছে! তাহলে তো আপনার এ চাকরিটা না করলেও চলে,তাই না? না,না এই মুহুর্তে এসব ভাবছি না। আমাকে আরোও কিছুদিন এ চাকরি করতে হবে। তাছাড়া,আমার বন্ধুরা প্রায় এখন মন্ত্রী-আমলা আর সেই তুলনায় আমি এখন কিছু না। বর্তমানে,তাদের সমান না হতে পারি,কিন্তু আমার কাছে যদি দুই-এক কোটি টাকা না থাকে,তাহলে কি চলে? কথাটা শুনে আমি পুরা অবাক হয়ে গেলাম। এই লোকটি বলে কি! যে কিনা একটা ৬-৭ হাজার টাকার চাকারি বাঁচাতে মরিয়া,সে কিনা দুই এক কোটি টাকার স্বপ্ন তার চোখে। খুবই আশ্চর্য একটা ব্যাপার! আমি বিস্ময়ের চোখে একটা কথাই বললাম,ঠিক আছে আপনার কথা। তবে বলি কি,এই মুহুর্তে মাদারিপুরে জয়েন্ট করা আপনার জন্য একান্তই জরুরি,যদি কিনা আপনি এই চাকরিটা করতে চান। লিয়াকত সাহেব হতাশ মুখে এদিক-ওদিক তাকিয়ে নিয়ে বলল,ঠিকই বলেছেন। এছাড়া যে এখন আমার কোন উপায় নাই। 
তার পরের দিন লিয়াকত সাহেব মাদারিপুরের উদ্দেশ্য রওনা দিল। তবে,তার ধারনা এই বদলিটা ইয়াদ সাহেব তাকে করিয়েছে। বেচারি অনেক কষ্ট করে তার স্ত্রীকে বদলি করে শরীয়তপুরে নিয়ে এসেছিল। আর আনার মাত্র এক সপ্তাহের মধ্যে তার বদলি অন্যখানে। একই বলে বিধি বাম! এদিকে,আলী আহমেদ সাহেব খুব দাপুটের সহিত অফিস চালাচ্ছেন। নব্য ফোর ইনচার্জ বলে কথা। সুতারং,ইয়াদ হোসেনের মন খুব খারাপ হঠাৎ তার ক্ষমতা চলে যাওয়াতে। বাস্তুত পক্ষে,ইয়াদ হোসেনের সাথে আলী আহমেদের একটা বিবাদ আছে বহুদিনের। যার দরুন,একবার আলী সাহেবকে জাজিরা থেকে ট্রান্সফার করে ফরিদপুরে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। কিন্তু ইয়াদ হোসেন বলে,আমি তাকে ট্রান্সফার করার কে! সে বদলি হয়েছে তার স্বভাবের কারণে। সে মানুষের সাথে ভাল ব্যবহার করত না,সেজন্য সে চেয়ারম্যানের বোনের জুতা পেটাও খাইতে গিয়েছিল একবার। এসব বিভিন্ন কারণে ম্যানেজমেন্ট সিদ্বান্ত নেয় তাকে ট্রান্সফার করবার। আর এখন যদি সে আমাকে দোষারোপ করে তাহলে তো হবে না। কিছুদিন যেতে না যেতে শুরু হল মনস্তাত্বিক যুদ্ধ। আলী আহমেদ পাশের ঘর থেকে কারণে-অকারণে ইয়াদকে ডাক দিবে। আর ইয়াদ সেই ডাকের উত্তর দিতে বাধ্য। যেহেতু,সে এখন নব ফোর ইনচার্জ। যখন ইয়াদ হোসেন ঐ ঘর থেকে উঠে আসে,তখন স্পষ্ঠ মুখ দেখে বুঝা যায় ভিতরে তার প্রচন্ড ক্ষোভ ঝরে ঝরে পড়ছে মাটিতে। কিন্তু কিছুই করার নাই। এরপর কিছুদিন যেতে না যেতে দেখা গেল,শুধু ইয়াদ না,এই দাবানল থেকে রেহাই পাচ্ছি না আমিও,এমনকি পিয়ন রাসেলও। দিন দিন অফিসের পরিবেশ ভারি হতে লাগল। আমি এখন বাড়ি যাওয়ার জন্য ছুটি নিতেও সাহস পাচ্ছি না। কারণ,জানি ছুটি চাওয়া তার কাছে বৃথা। কিন্তু ইয়াদ হোসেন যখন ইনচার্জ ছিলেন তখন দু‘দিনের জায়গায় চারদিন কাটালেও কোন ‘টু’ শব্দটিও করতেন না। কারণ,সে জানতেন আমি অনেক দুরের পথের মানুষ,আমাকে যদি দু‘দিন ছুটি ধরে না দেওয়া হয়,তাহলে আমার প্রতি অবিচার করা হবে। এজন্য,ছুটির ব্যাপারে তার কাছে ছিল বিশাল শিথিলতা। 
একদিন রাসেলও ক্ষোভের সহিত আমাকে বলল,স্যার এ অফিসে আমি পাঁচ বছর কাজ করেছি,কিন্তু নতুন ইনচার্জ আসার পরে এই প্রথম আমি ছুটি চেয়ে বিমুখ হলাম। তবে,সামনের মাসে আমি আমার বোনকে নিয়ে ঢাকায় যাব অসুূখ দেখানোর উদ্দেশ্যে। যদি সে আমাকে ছুটি না দেয়,তবুও আমি ঢাকায় যাবই যাব। তাতে,আমার চাকুরি থাকুক আর নাই থাকুক। মোটামোটি,এখন বলা যায় আগের অফিসের পরিবেশ আর এখনকার অফিসের পরিবেশের মধ্যে বিশাল ব্যবধান তৈরি হয়েছে। আর সেই ব্যাবধান নষ্ট করে দিয়েছে পরস্পরের প্রতি বিশ্বাস,ভালবাসা,ভ্রাতৃত্ববোধ। এরমধ্যে,হঠাৎ ইয়াদ হোসেন অফিসের সবাইকে জানিয়ে দিল আগামিকাল ফরিদপুর থেকে নতুন উন্নয়নের ইনচার্জ আসছে। জানিনা,এবার আমাদের কোম্পানী কেমন চলবে। আলী সাহেব,ইয়াদ এর মুখের কথা কেড়ে নিয়ে বলল,যা হবার হবে। এটা নিয়ে এত চিন্তা করার কি আছে? না বলছিলাম,এমনি সরকার এ বছর ১১টি নতুন বীমা কোম্পানীর অনুমোদন দিয়েছে,তাই নিয়ে আমাদের হেড কোয়ার্টার পর্যন্ত চিন্তিত কখন কোন কর্মচারী চলে যায়। কারণ,নতুন কোম্পানী হিসাবে বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা তো দিবেই তারা প্রতিষ্ঠিত হওয়ার জন্য। শুনুন,ওসব ভেবে আমাদের কোন লাভ নাই যা হওয়ার হবে। কিন্তু একটা কথা সবাইকে বলে রাখছি,আমরা যারা প্রশাসনিক বিভাগে আছি,তাদের সবাইকে সব-সময় এক থাকতে হবে। কথাটা শুনে আমার মাথা ভোঁ,ভোঁ করে ঘুরতে লাগল। যে কিনা সব সময় অফিসে বিশৃঙ্খলতায় ভরপুর করে রেখেছে,সে কিনা বলে এক হওয়ার কথা। ভারি আশ্চর্যের কথা! কারণ,উন্নয়নের ইনচার্জ এসে নাকি লবিং-গ্রুপিং তৈরি করে যাতে প্রাশাসনিক ইনচার্জ দুর্বল হয়ে পড়ে কিনা এ বিষয় নিয়ে আলী আহমেদ একটু চিন্তিত! যেহেতু,বহুদিন যাবৎ এ প্রতিষ্ঠানে কাজ করে আসছে সে,তাই এ বিষয়টি খুব ভাল জানে। এই মুহুর্তে পাঠকদের একটা কথা না বললে নয়,লাইফ ইনসিওরেন্স কোম্পানিতে দুটি বিভাগ আছে একটি  উন্নয়ন আর একটি প্রশাসনিক। কেউ কেউ উন্নয়নদেরকে আউট ডোর আর প্রসাশনিকদের ইনডোর বলে। যাহোক,এখন যেটা দেখা যাচ্ছে সেটা হল আলী আহমেদ মুখে কিছু না বললেও নতুন উন্নয়ন ইনচার্জ আসাতে প্রশাসনিক ইনচার্জ কিছুটা হলেও ভিতু। কিন্তু সে বড় পদে অধিষ্ঠিত আছে বলে,তার অধিনাস্ত কর্মচারীদেরকে সেটা বুঝতে দিচ্ছে না। ব্যাটা বড়ই ধুরন্ধর,চালাক প্রকৃতির লোক! হাজার বিপদের মাঝেও নিজের অবস্থান কাউকে বিন্দুমাত্র বুঝতে দিতে নারাজ। 

অফিস শেষে ৬টার পর বাড়ি ফিরলাম আমি। বর্তমানে বাড়ির চিন্তা,ছেলের চিন্তা,অফিসের চিন্তা সবকিছু মিলে আমার জীবনটাকে একেবারে ঝালাপালা করে ফেলেছি। সারাক্ষণ কেমন জানি মন মরা অবস্থায় বসে থাকি। এতদূর বসে আমি কি যে করবো ভেবে পাচ্ছি না তার কিছু। বৌ-বাচ্চাকে যে কাছে নিয়ে আসবো সেটাও সম্ভব নয়,কারণ এই স্বল্প বেতনে বাড়ি ভাড়া দিয়ে,মাসের খরচ দিয়ে পেরে উঠা খুব কঠিন! তারপর আবার শরীয়তপুর বলে কথা। প্রত্যেকটা জিনিসের দাম আকাশচুম্বি! বিক্রেতা মুখ দিয়ে একবার যেটা বলবে,সেটার কোন দাম পরিবর্তন করবে না। লোক মুখে শোনা যায়,এদের বেশির ভাগ লোক বিদেশে থাকে বলে,এরা টাকাকে টাকা মনে করে না। তারপরও নাকি যেন তেন দেশে এরা থাকে না, ইটালীতে নাকি বেশির ভাগ লোক থাকে। ইতালী হল ইউরোপের একটা উন্নত দেশ। সেই হিসাবে ওদের কাছে টাকাটাও বেশি থাকা স্বাভাবিক। আবার কেউ কেউ বলে সেজন্য নয়,কারণটা হল যোগাযোগ ব্যবস্থার কারণে। যাহোক,যেটাই হোক না কেন এখানে বর্তমান দ্রব্য মূল্যর দাম উর্দ্ধগতিতে। এদিকে,মেসের পরিবেশ দিনের পর দিন কেমন জানি ভারি হয়ে উঠছে,অন্যদিকে আমাকে মেসে ধরে রাখার জন্য দাদা বিভিন্ন-কলা কৌশল আঁটছে। কিছুদিন আগে আমি স্পষ্ঠ জানিয়ে দিয়েছে যে,আমি আর এই মেসে থাকবো না। কারণ,আমার অফিসের কলিগ ইয়াদ হোসেন চমৎকার একটা টিন সেডওয়ালা বাড়ি দেখেছে। এখন আমি সেখানে উঠতে চাই। এতে আমার কিছুটা হলেও ব্যয়টা সংকোচন হবে। কথাটা শুনামাত্র দাদার মাথা ভোঁ,ভোঁ করে ঘুরছে সেই থেকে। কারণ,আমি যদি মেসে ছেড়ে যায় তাহলে তার ইংলিশ শেখাটা বন্ধ হয়ে যাবে। আর সেই সাথে হারাবে তার বড় চাকরি পাওয়ার স্বপ্ন। তাই,সে এখন প্রতিটি মুহুর্তে কিভাবে আমাকে আটকানো যায়,সেই ফন্দি-ফিকির করছে। 
এই মেসের ম্যানেজার যদিও সোহেল। কিন্তু এটা নাম মাত্র। দাদা পিছন থেকে সব কিছুর কল-কাঠি নাড়ে। কিন্তু কোন সমস্যা  হলে তাকে বললে বলে,আমি কিছু জানিনা। সোহেলের কাছে যান। সে হল মেস ম্যানেজার। আশ্চর্য চরিত্রের লোক এই রাজকুমার দাদা। সে বর্তমানে মেসে এমনভাবে চলে,তাকে যেন কেউ কোন প্রকার দোষ দিতে না পারে। কারণ,সে ভাল করে জানে মেসের দুইজন মাত্র হিন্দু আর বাকিবাদ সব মুসলমান। কোন একটা সমস্যা হলে তার নিস্তার নাই। এজন্য প্রতিটি পা সে খুব সাবধানে ফেলে। আর তার বড় গুনের একটা লক্ষনীয় বিষয় হল,মুসলমান-মুসলমানের ভিতর দ্বন্ধ তৈরি করে রাখা। কারণ,সে ভাল করেই জানে যদি একবার তারা এক হয়ে আমার বিরুদ্ধচারন শুরু করে তাহলে,তার আর পালাবার পথ থাকবে না। তাই,তার অদৃশ্য মায়াজাল খুব সুকৌশলে মেসে ছড়িয়ে রেখেছে। রাজকুমার দাদা,কিছুতেই ভাবতে পারছে না আমার চলে যাওয়াটা। সে তার চাকরি নিয়ে বড় বড় স্বপ্ন দেখছে,সে নিজেই চার চাকাওয়ালা গাড়ি চালাচ্ছে সাঁই,সাঁই করে। নিজেস্ব ফাটও হয়েছে। ফাটে মোজওয়ালা দারওয়ানও বসিয়েছে। আর বাড়ির সামনে রয়েছে রঙ-বেরঙের বিভিন্ন ফুল ও ফলের গাছ। কিন্তু তা পাইতে গেলে তো তাকে ভাল করে ইংলিশ শিখতে হবে। আর সেই শিক্ষার একমাত্র বাহক হল বর্তমানে আমি। আর আমি কিনা মেস ছেড়ে চলে যাব! না,এটা কিছুতেই হতে পারে না। দাদা দেখল,যেভাবেই হোক আমাকে আটকাতে হবে।   
তাই,একদিন আমার বিছানার এক পাশে এসে কাতর স্বরে বসে বলল,ভাইজান আপনি কি ঘুমিয়ে পড়েছেন? এমনভাবে বলল,যেন খুব অসহায় একটা লোক আমার কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করছে। না,বলুন দাদা কি হয়েছে আপনার? না,মানে বলছিলাম কি আপনি কি সত্যই এই মেস ছেড়ে চলে যাবেন? হ্যাঁ,কেন? না মানে,এই বিষয়টা কি আর একটু ভেবে দেখলে হয়না। তাছাড়া,এতদিন আপনি আমাদের সাথে থাকলেন,চললেন,ফিরলেন হঠাৎ করে চলে গেলে তো সবারই খারাপ লাগে তাই,নয় কি? কিন্তু দাদা আপনার কথা তো আমি সবই বুঝলাম কিন্তু আমার তো কিছু করার নাই। এমনি এ শহরের প্রত্যেকটি জিনিসের দাম বেশি। তারপর,মেস ভাড়া প্রায় এক হাজার টাকা। বোঝেন তো আমার বেতন বেশি না। সবকিছু বুঝে-শুনে খরচ না করলে আমি বিপদে পড়ে যাব। দাদার মুখে কোন কথা নাই। কি দাদা কোন কথা বলছেন না যে? কি আর বলবো ভাই,চলেই যদি যান তাহলে আমি কি আর করতে পারি,দেখুন আপনি যেটা ভাল মনে করেন। আমি স্পষ্ঠ দেখতে পেলাম দাদার কোথায় যেন না-পাওয়ার বেদনা তাকে কুরে কুরে খাচ্ছে। কিন্তু এদিকে এ অবস্থা আর অন্য দিকে মায়ার টান। 
কিছুদিন আগে মেসে ঘটা যাওয়া একটা ঘটনা আমাকে পোড়ায় সারাক্ষন। ঘটনাটি হল,মেসের হাড়ি,পাতিল,থালা-বাসন এই গুলির চার্চ বাবদ তিনশত টাকা দাবি করেছিল এগার দিন খাওয়া বাবদ। যাহা আমি ইচ্ছা করলে তা দিয়ে নিজেই নতুন হাড়ি,কড়াই কিনতে পারতাম। তারপরও মুখ বুজে মেনে নিতে হয়েছিল এ অযৌক্তিক প্রস্তাব। সেদিন দাদা কিন্তু পিছন থেকে এ প্রস্তাবের উৎসাহ দিয়েছিল। কিন্তু ঘটনাটি যখন গ্যাঞ্জামের পর্যায় পৌঁছাল,তখন সে কিছু জানে না,জানে সব ম্যানেজার সোহেল। আশ্চর্য ছিল সেদিন তার ভুমিকা! সেই কান্ড ঘটাতে এতটুকু ভাবল না সে,যাকে এই অন্যায় প্রস্তাব চাপিয়ে দিচ্ছি তার কাছে আমি অল্পের জন্য হলেও ঋনি আছি। সেদিন এর সেই অকৃতজ্ঞতামুলক ব্যবহার আমি ভুলতে পারিনি। তারপরও তার মুখের কাতরতা এবং মেসের অন্যান্য সদস্যদের কথা চিন্তা করে বলে ফেললাম,ঠিক আছে আমি যাচ্ছি না মেস ছেড়ে। তবে,একটা শর্ত আছে দাদা। হাসি মুখে বলল,বলুন ভাই। বলছি দেখুন,আমার চাকরিটা হল ট্রান্সফারেবল চাকরি। যখন-তখন বদলি অর্ডার আসতে পারে। তাই বলছি,যদি ২০ তারিখের আগে কখনও বদলি হতে হয়,তাহলে আমাকে ঐ মাসের ভাড়া নিয়ে ছেড়ে দিতে হবে,অন্য কিছু দাবি করতে পারবেন না। অথবা অন্য যে কোন কারণেই হোক মেস ত্যাগে একই নিয়ম প্রযেজ্যে হবে আমার ক্ষেত্রে। আপনি বলতে পারবেন না,পরবর্তী মাসের ভাড়া আমাকে দিতে হবে। এটা আমার সাফ কথা! বলুন,এতে আপনি রাজি কিনা? দাদা আর কোন কিছু না ভেবে বলল,রাজি। তাহলে সোহেলকে ডাকুন,পরে বলবেন আমি কিছু জানিনা,ওটা হবে না। আরে ভাই,এ নিয়ে আপনি এত চিন্তা করছেন কেন? আমি যখন দায়িত্ব নিয়েছি,তখন আপনাকে এসব নিয়ে কোন চিন্তা করতে হবে না। পরে আমি সব কিছু সোহেলকে গুছিয়ে বলবো। ঠিক আছে দাদা বিষয়টা যেন আপনার মনে থাকে,পরবতীতে যেন কথা-বার্তা উল্টা-পাল্টা না হয়। না,না ভাইজান আপনি যে কি বলেন,আমি এমন মানুষ হতে পারি। শুনুন,মুখ দিয়ে যা একবার জবান দিব,সেই মোতাবেক আমি তাই পালন করবোই,করবো। নারায়ন! আমাকে তুমি রক্ষা কর বলে তিনি তার রুমে চলে গেল। 
কিন্তু দেখা গেল,কিছুদিন যাওয়ার পর দাদা ও অন্যান্য মেস মেম্বারদের আচারণ ঠিক আগের মতই শুরু হয়ে গেল। বরং,এক প্রকার বলা যায় আরও বেশি। মেসের সোহেল,সুমন,জাকির সবাই। আর দাদার ভুমিকা সেই রহস্যময়তায় ঘেরা! আমি তবুও ধৈর্য ধারন করতে লাগলাম। দেখি,আরও ভালবাসা,¯েœহ দিয়ে ওদের চরিত্রকে পরিবর্তন করা যায় কিনা;হাজার হলেও তো তারা রক্তে-মাংসের মানুষ। পরিবর্তন হলেও হতে পারে। কিন্তু আমার চিন্তা ছিল শূন্যসার। একদিন একটা ঘটনা ঘটল,দাদা হাঁপাতে হাঁপাতে আমার কাছে এসে পড়ল। কি ব্যাপার দাদা,আপনি এমন হাঁপাচ্ছেন কেন? কোন সমস্যা? আর বলেন না ভাই,শুধু সমস্যা এ এক বড় মহা সমস্যা! আহা! বিষয়টা একটু খুলে বলুন। শুনুন তাহলে,ঐ যে সুমন নামে যে ছেলেটা দেখছেন না। হ্যাঁ তো হয়েছে কি? আহা! ভাই আমাকে কথাটা শেষ করতে দিন। ওরা তিন জন যখন নিজেদের মধ্যে আলাপ করছিল,তখন আমি ঘুমের ভান করে শুনতে পেলাম,সে সোহেল ও জাকিরকে বলছে সে একটা ইসলামিক সংগঠনের সাথে জড়িত। সে নাকি তাদের সাথে থেকে অস্ত্র ট্রেনিংও নিয়েছে। আচ্ছা দাদা,বিষয়টা একটু ভাবুন তো হিন্দু হয়েও সে একটা ইসলামিক সংগঠনের সাথে জড়িত! কি ডেঞ্জারেস ব্যাপার,তাই না বলুন? আরে দাদা এই টুকুতে আপনার এই অবস্থা! আমি তো আরও বড় একটা কাহিনী জানি,যা শুনলে তো আপনার পিলে চমকে যাবে। দাদা সাথে সাথে আগ্রহের সহিত চেয়ার কাছে টেনে নিয়ে এসে বলল,কি ঘটনা ভাই বলুনতো? তাহলে গত পরশু দিনের একটা ঘটনা শুনুন ঐ সুমনকে দেখেছেন না,তাকে ঐরকম দেখলে কি হয়,আপনি যতটুকু ভাবছেন তার থেকে সে আরও ঘড়েল মাল! কি বলছেন ভাই,কেন কি জানেন আপনি? একটু খোলসা করে বলুন আমার যে আর তর সইছে না। তাহলে শুননু,ওর বাড়ি কোথায় জানেন? কেন নড়াইল। না,ওর আসল পরিচয় হল সে বরিশালের মাল। সে সোহেলের কাছে এ কথা বলছিল সেদিন। আর বর্তমান সে নড়াইলে সেটেল। ও যে মেয়েকে বিয়ে করেছে,জানেন এই মেয়ের অন্যত্র এক ধনী পরিবারের সাথে বিয়ে হওয়ার কথা ছিল। বিয়ের রাত্রে সে তার বন্ধু-বান্ধবদের সহযোগিতায় মেয়েকে ভাগিয়ে এনে বিয়ে করে। এই মেয়ে নিয়ে পালিয়ে আসার সময় বাঘারপাড়া নামক এক জায়গায় জনগণের কাছে ধরা পড়ে সে। কিছু পাবলিক তাকে টাকার বিনিময়ে ছেড়ে দেওয়ার কথাও দিয়েছিল,কিন্তু সে টাকা দিতে অস্বীকৃতি জানানোর ফলে,তার কিছু দিনের জন্য নিবাস হয়েছিল জেলখানায়। প্রায় দেড় মাস জেলখাটার পর কারা মুক্তি লাভ করে এবং পরবর্তীতে,জেল গেট থেকে নাকি তাকে ফুলের মালা দিয়ে বরণও করেছিল তার বন্ধু-বান্ধবরা। এই কথাগুলি যখন সে বলছিল,তখন তার মুখ দেখে মনে হচ্ছিল সে একজন গর্বিত পুরুষ! তারপরও আমার কেমন জানি ওর কথাগুলি ফাকা আওয়াজ মনে হয়। মাঝে মাঝে মনে হয় সে নিজেকে হাই লাইট করার জন্য এসব কথাগুলি বানিয়ে বানিয়ে বলছে। না,না কি বলেন ভাই! আমার কাছে কিন্তু সব কিছু সত্য মনে হয়। আমার তো এখন ভয় লাগছে এ মেসে থাকতে। দেশের যে অবস্থা তাতে যখন-তখন ওর সাথে আমরাও না এরেষ্ট হয়ে যায়। এতে কোন আমার সন্দেহ নাই। না,এখন থেকে গ্যাটে শুবার আগে তালা লাগাতে হবে। জানিনা,কখন কি হয়। ভাই,এখনতো সে বাসায় কেউ নাই,ওর ব্যাগটা একটু চেক করলে কেমন হয়? কেন? না,মানে ব্যাগের ভিতর কোন বোমা-টুমা আছে কিনা। আমি হেসে বললাম,না,না ওসব কোন সমস্যা নাই। তবে,আপনি দাদা ভুলেও ঐ কাজটি করবেন না। যদি ব্যাগে বোমা থেকেও থাকে আপনার নাড়াচড়াতে সেটা বাষ্ট হয়ে যাওয়ার সম্ভবনা বেশি। এমনকি,আপনি মারাও যেতে পারেন। দাদা কিছুক্ষন চুপ থেকে বলল,ভাই আপনি একেবারে সঠিক কথা বলেছেন। এরপর থেকে দাদা সুমনের প্রতিটি হাঁটা চলা-ফেরা সন্দেহের চোখে দেখতে লাগল। মাঝে হল কি একটা ঘটনা,একটা ভাঙ্গা পাতিলে সুমন কিছু হলুদ আর কি সব মাখিয়ে রেখে দিয়েছে ছাদের এক কোণে। সেটা দিয়ে তার ক্ষত পায়ে জাব না-কি যেন দেয়। কারণ,কিছুদিন হল সে ফুটবল খেলতে গিয়ে আঘাত প্রাপ্ত হয়। এজন্য,সে ডাক্তারও দেখিয়েছে। তাতে,সুস্থতার নাম বালাই নাই। তাই বাধ্য হয়ে নিজেই সে এ ঔষধের আবিস্কার করেছে। কিন্তু যখনই দাদা শুনেছে এটা সুমন রেখেছে ছাদের কোণায়,আর তখন থেকে তার ভয় শুরু হয়ে গিয়েছে। তার ধারনা,নিশ্চয় ওতে কোন বিষ জাতীয় কোন কিছু আছে। নইতো বা বিস্ফোরক জাতীয় কোন কিছু। যা দিয়ে হয়ত,সে ভবিষ্যতে বোমা-টুমাও বানাতে পারে। বিষয়টা বড়ই দুঃচিন্তার! তাহলে এখন কি করা যায়! দাদা বিছানাতে ভাল করে ঘুমাতেও পারে না। আর ভুল ক্রমে ছাদের ঐ কোণাতে পাড়াও দেয় না। আমি খেয়াল করলাম দাদার এ অবস্থা! 
একদিন না পেরে আমি তাকে ডেকে বললাম,দাদা এটা ভয়ানক কিছুনা। এটা ওর পায়ে দেওয়ার জন্য কি একটা ঔষধ বানিয়েছে সে নিজে। দাদা অবাক দৃষ্টিতে চেয়ে আছে আমার দিকে। কি বলছেন ভাই! আপনি সঠিক জানেন তো। দেখুন,একটু অসতর্কতার জন্য আপনার আমার জীবন শেষ হয়ে যেতে পারে। একটু ভেবে-চিন্তে কথা বলুন। না,না দাদা আপনি নিশ্চিত থাকুন,ওসব নিয়ে আপনার কোন সমস্যা হবে না। ঠিক আছে আপনার কথা মেনে নিলাম। কোন সমস্যা না হলেই আমাদের সবার জন্য ভাল। আর হলে সবারই বিপদ!  
আহা! দাদা আপনি বুঝতে পারছেন না কেন,বিষয়টা খুবই সাধারণ একটা বিষয়। দেখুন ভাই,আপনি যতই বলেন না কেন সাধারণ বিষয়,আমার কিন্তু মোটেই ভাল লাগছে না।

আজ বাবা দিবস। তন্ময়কে কাছে পেলে অনেক ভাল হত। কিছু না-পারি একটা চুমু তো দিতে পারতাম তার রাঙা দুটি গালে। কিন্তু সেটাও সম্ভব নয়। যদিও মোবাইলের মাধ্যমে কিছুটা অনুভূতি প্রকাশ করা সম্ভব। কিন্তু তারপরও একটু হলেও অপূরণ থেকে যায়। যেমন বৃষ্টি শেষে আকাশের গায়ে রঙ-ধনুর জেগে উঠার মত। আচ্ছা,দেখি দুষ্টুটি কি করছে। মোবাইলে রিং দেওয়ার সাথে সাথে ওপাশ থেকে অনন্যা ধরল। 
কি ব্যাপার,আজ যে সাহেবের এত সকালে ঘুম ভাঙ্গল যে? কোন খবর-টবর আছে নাকি? না,,এমনি। এমনি তো ইদানিং তুমি বেশি একটা কোন ফোন-টোন দাও না আমাকে,নেহায়েত ছেলের কথা মনে না পড়লে। কথাটা এই মুহুর্তে তুমি খারাপ বলোনি। তা আমার ছেলেটি কোথায়? ওহ! ছেলে আগে,আর আমার খবর কে নিবে? আহা আমি কি তাই বলেছি? তুমি কি ভুলে গিয়েছো আজ না বাবা দিবস। ওহ! তাই বল। তো তোমার স্ত্রী দিবস কবে হবে? স্ত্রী দিবসে তো এই রকম কোনদিন গরম,গরম ফোন কখনও পায়নি? আচ্ছা,তোমার হল কি,তোমার নিজের ছেলে সাথে তুমি ভালবাসা নিয়ে হিংসা করছো? হিংসা করবো কেন? দেখছি তোমার দিবস সম্পর্কে সচেতনতাবোধ। আচ্ছা,তোমার এসব হেয়ালি কথা না বলে তন্ময় এর কাছে মোবাইলটা দাও না একবার। অনন্যা যখন গলা হাক ছেড়ে তন্ময়কে ডেকে বলল,তন্ময় তোমার বাবার ফোন। সাথে সাথে সে ছুঁটে এসে দু‘হাত দিয়ে ফোনটা ধরল। ভাঙ্গা ভাঙ্গা গলায় বলল,আব্বু,আব্বু। হ্যাঁ,আব্বু তুমি ভাল আছো? সে কোন কথা না বলে দাঁত বের করে হাসতে লাগল। তন্ময় তোমার জন্য বাড়ি ফিরলে কি আনতে হবে? আবারও সে হেসে বলল,বল,বল। আচ্ছা তোমার জন্য একটা বল নিয়ে আসবো। আর শোন,তোমার আম্মুর কথা সব সময় শুনবে। এবার তোমার আম্মুর কাছে মোবাইলটা দাও। সাথে সাথে ওর আম্মুর কাছে মোবাইলটি এগিয়ে দিল। কি ব্যাপার,তোমার ছেলে আমার কাছে মোবাইলটা দিল কেন? কেন আবার আমি দিতে বলেছি তাই। ওহ! তাহলে এত তাড়াতাড়ি তোমাদের কথা বলা শেষ। এবার বল,কি বলবে আমায়? শোন,একটা সুখবর আছে। কি সুখবর? শোন,আমার মনে হয় তাড়াতাড়ি যশোরে ট্রান্সফার হয়ে যাবে। তখন দেখবো তোমার কত অভিমান আছে আমার বিরুদ্ধে,সব আমি এসে একটা,একটা করে ভেঙ্গে দিব। হুম! সত্যই তোমার ট্রান্সফার হবে! এতদিন পর তাহলে একটা ভাল সংবাদ দিলে। তো কবে হবে? খুব তাড়াতাড়ি। কিন্তু এটা হলে তো আর আগের মত আমাকে সময় দেবে না। দিলে দিবে,তোমার ছেলেকে। তাতে আমার লাভ কি? তখন দেখা যাবে আমি পড়ে আছি ঘরের এক কোণে আর ওদিকে তুমি আর তোমার ছেলে এক সাথে মিলে খেলা-ধুলা করছো। আচ্ছা অনন্যা, ইদানিং তোমার হয়েছে কি? আমি খেয়াল করে দেখেছি,আমার ছেলেকে প্রায় তোমার প্রতিদ্বন্ধি ভাবছো। কি সব বলছো,তোমার ছেলে,তোমার ছেলে বলছো কেন? ছেলে কি আমার নয়? এখন এসব বাদ দিয়ে বল,এ মাসে কি ট্রান্সফার হওয়ার সম্ভবনা আছে? আরে বাবা,তোমার দেখছি আর তর সইছে না। তবে,অফিসিয়ালি যেসব প্রক্রিয়া প্রস্তুত করার দরকার,তা সব কিছু রেডি করে কাগজ-পত্র সব হেড অফিসে পাঠিয়ে দিয়েছি। এখন শুধু প্রহর গুনছি,কবে আমার বদলি চিঠি আসবে। যা হোক,আমার কিন্তু এখন থেকে কেমন কেমন লাগছে। আচ্ছা,তুমি আসলে কিন্তু প্রতি শুক্রবার আমাকে নিয়ে ঘুরতে বের হবে। আচ্ছা,কোথায়,কোথায় তোমাকে নিয়ে বের হতে হবে? আমার যেমন খুশি,ধর জেস গার্ডেন,বিনোদিয়া,বোট কাব। এতটুকু হলে খুশি? না,না শহর ছেড়ে আরোও অনেক দূরে,যেখানে জন-মানবহীন। শুনশান নীরবতা প্রতি নিয়ত বাসা বাঁধছে। তারপর ঐ দিগন্তের আকাশ আর মাটির মিলন দেখতে চায়। শুধু তোমার হাত ধরে । এই দাঁড়াও,দাঁড়াও তোমার কথা-বার্তা শুনে মনে হচ্ছে,তুমি তো কবি হয়ে গিয়েছো। আমার মনে হচ্ছে কি যান,আর বদলির অপেক্ষা না করে,এক্ষুণি দি ছুঁট। 
কি আমার সাথে ফাজলামি করা হচ্ছে,তাই না? আগে এখানে এসো,তারপর দেখাচ্ছি তোমার মজা। আমি মনে মনে ভাবতে শুরু করলাম,আমি স্ত্রী-পুত্র নিয়ে বেরিয়ে পড়েছি অজনার উদ্দেশ্য। পৃথিবীর কোন ভাবনা আমাকে গ্রাস করতে পারছে না,শুধু আমার স্ত্রী-পুত্র ছাড়া। নেই অফিসের চিন্তা,নেই মেসের চিন্তা ছাড়াও ছোট-বড় অদ্ভুত সকল সমস্যা। আমি এখন মুক্ত। আমাকে সইতে হচ্ছে না বিচিত্র মেসের মানুষের কার্যক্রম,সইতে হচ্ছে না অফিসের স্টাফদের হিংসাত্বকমুলক আচারণ। কি আনন্দ না মনে! এসবই পূরণ হবে একটা ট্রান্সফারের চিঠির মাধ্যমে। আমার মনে হতে লাগল আজকেই অফিসে গেলে দেখতে পাব ট্রান্সফারের সেই স্বপ্নের চিঠি। হঠাৎ,ওপাশ থেকে অনন্যার ধমকে চেতনা ফিরে পেল। কি  ব্যাপার,সাহেব এর মুখে কোন কথা নাই যে? না,মানে তোমার মতই ভাবতে ভাবতে নিজেকে হারিয়ে ফেলেছিলাম। অনন্যা,ওর কথা শুনে খিল,খিল করে হাসতে হাসতে বলল,এখন রাখো ওদিকে আমার আবার অনেক কাজ পড়ে আছে। 
হিমালয় কিছু দিন হল শরীয়তপুরের সাংস্কুতিক কিছু সংগঠন এর সাথে যুক্ত হয়েছে। তাদের কবিতা,গান,গল্প তার কাছে খুব ভাল লাগছে। বস্তুতঃ সে নিজেই গান-কবিতা লিখতে ও পড়তে ভালবাসে। অল্প কিছু দিনের মধ্যে কিছু কবি বন্ধুদের সাথে বেশ ভাবও জমে গিয়েছে। তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য নাম কামাল মল্লিক,মেহেদি ভাই,মির্জা ভাই,কোহিনুর আপা ছাড়াও আরোও অনেকে। তারমধ্যে কবি কামাল মল্লিকের সাথে সবচেয়ে বেশি সখ্যতা গড়ে উঠল। সে কারণে-অকারণে আমাকে ফোন দিতে লাগল। আবার আমিও তাকে আমার থেকে বয়সের ছোট হওয়াতে প্রচন্ড ¯েœহ করতে শুরু করলাম। আজ আমরা দু‘জনে বসে আছি কীর্তিনাশা নদীর পাড়ে। নদীর শান্ত রূপ আমাকে ভীষণভাবে আলোড়িত করল। আচ্ছা কামাল,এই নদীর কুলকুল জলের ¯্রােতের শব্দ হয়ত কত শত বছরের বয়ে চলা। আমাদের পূর্ব পুরুষেরাও হয়ত কেউ না কেউ এই দুশ্যমান জন-বসতির ন্যায় দুই পাড়ে বাস করত। কিন্তু দেখ,তারা আজ স্মৃতির আড়ালে চলে গিয়েছে। তাদের নিয়ে আজ কেউ কোন কথা ভাবে না। যেমনটি ভাবে না এই প্রবাহমান ¯্রােতের কথা। ভাই,আপনার মত এভাবে কখনও ভাবিনি। তবে,বিষয়টা তো আসলই খুবই অদ্ভুত! আর দেখ,আমরা এখন আছি একটা সময় আমরা থাকবো না,এটাও সত্য। আমাদের জায়গায় আর এক প্রজন্ম বসবে আর আমাদের মত তারাও ভাববে,যা আমরা এখন ভাবছি। ভাই এটাও সত্য। 
সাথে সাথে এটাও ঠিক যে,এই আমরা দু‘জন পাশাপাশি বসে আছি,একটা সময় হয়ত এভাবে ঘনিষ্ঠ হয়ে আর বসা হবে না। তবে,ভাই সত্য কথা বলতে কি,আপনার অনউপস্থিতি আমাকে ভিষণভাবে কাঁদাবে প্রতিক্ষণ। আচ্ছা কামাল,তুমি কি গান জানো? না ভাই,আমার গলা তেমন ভাল না। তার চেয়ে বরং আপনি একটা গান ধরেন আমি শুনি। সাথে সাথে আমি গান ধরলাম,“একদিন মাটির ভিতরে হবে ঘর রে মন আমার কেন বান্দো দালান ঘর” গান শেষে আমি নদীর কুলকুল বয়ে যাওয়া ¯্রােতের দিকে একমনে চেয়ে থাকলাম। ভাই এত উদাস হয়ে কি ভাবছেন? না এমনি হঠাৎ পৃথিবীতে মানুষের আসা-যাওয়ার কথা মনে পড়ে গেল। কি বৈচিত্র না একবার ভাবলে আর কিছুই ভাল লাগে না। আচ্ছা ভাই,আমাদের“রুদ্র বার্তা” পত্রিকায় আগামি সংখ্যায় আপনার কিছু লেখা দিন না। শুনেছি,আপনি নাকি লেখা-লেখির সাথে অনেকদিন ধরে জড়িত। হ্যাঁ,তুমি ঠিকই শুনেছো। ইদানিং,বিভিন্ন কাজের চাপে আমার তেমন লেখা-লেখি হচ্ছে না। তবে,তুমি যখন বলেছো, তখন কিছু একটা তো দিতেই হবে। কামাল হেসে বলল,ভাই আমি দৃঢ় আশাবাদি নিয়মিত কাগজে আপনার লেখা বের হলে পাঠকও আমাদের পত্রিকার সেল বাড়িয়ে দিবে। ভাই,এবার উঠি আবার আর একদিন বসবো দু‘জনে। সেদিন আমরা ফুল,পাখি সাহিত্য নিয়ে আরোও আলোচনা করবো। এখন উঠুন।

কীর্তিনাশা থেকে ফেরার পর আমি মেসে এসে দেখি সুমন পা দুটি জানালার সাথে দড়ি দিয়ে বেঁধে নাক ডেকে ঘুমাচ্ছে। আমি কয়েকবার ডাকার সত্ত্বেও তার ঘুম ভাঙ্গল না। এমন সময় দাদা ঘরে প্রবেশ করল। কি ব্যাপার,আপনি এভাবে দাঁড়িয়ে কি দেখছেন? আরে দাদা,একটু খেয়াল করে দেখুন সুমন কিভাবে ঘুমাচ্ছে। হায় রাম! এটা কি হচ্ছে মেসে। ভাই আমি আগেই বলেছি,একে আমার ইদানিং মোটেই সুবিধার মনে হচ্ছে না। কিন্তু কার কথা কে শোনে! এখন দেখেন,এই রকম অদ্ভুত কান্ড-কারখানা! না আর সহ্য করা যায় না। আগে সোহেল মেসে আসুক,এর একটা ব্যবস্থা আমায় করতে হবে। যখন যা মনে হচ্ছে তখন,তা সে করে যাচ্ছে অনায়াসে। এসব দেখার কি কেউ নেই? ব্যাটা কি মগের মুল্লুক পেয়েছে নাকি! আহা দাদা! আপনি বিষয়টি নিয়ে এত ভাবছেন কেন? কি বলেন ভাই,্এই রকম সব সময় করলে আর আমরা যদি তাকে কোন কিছু না বলি তাহলে তো,সে পরবর্তীতে আরোও উল্টা-পাল্টা কাজ শুরু করবে। হঠাৎ,দাদা জোরে জোরে সুমনকে ডাকতে লাগল। কি ব্যাপার দাদা,এভাবে ওকে ডাকছেন কেন? দাঁড়ান আমি কি করি,আপনি একটু দেখেন। দাদার গলার আওয়াজে মুহুর্তের মধ্যে সুমন ঘুম থেকে উঠে পড়ল। কি ব্যাপার তুমি এভাবে ঘুমাচ্ছো কেন? দাদা,এটা একটা ব্যায়াম। আমাকে তুমি শিখাচ্ছো ব্যায়াম কি জিনিস? তোমার থেকে আমি ভালই বুঝি ব্যায়াম কাকে বলে। দাদা আপনি মনে করে দেখেন,আপনি যে ব্যায়াম করেছেন জীবনে জাগ্রত অবস্থায়,ঘুমান্ত অবস্থায় নয়। আর এই ব্যায়ামের নাম হচ্ছে “ঘুমান্ত ব্যায়াম”। এই রকম নাম তো আমি জীবনে কখনও শুনি নাই। আহা দাদা,শুনবেন কোথা থেকে? এটা যে নতুন বের হয়েছে। এখন সবকিছু ডিজিটাল হয়ে গিয়েছে না,এনালগ নাই বললে চলে। যেমন ধরুন,আগে চিঠি লিখতেন কাগজ-কলমে,এখন লেখেন মোবাইলে এবং সেটা মুহুর্তের মধ্যে প্রেরকের কাছে পৌঁছায়ে যাচ্ছে। আর মনে রাখবেন,ব্যায়াম প্রতিটি প্রাণির জন্য সব সময় অপরিহার্য। এটা শুধু মানুষের বেলায় নয়,গরু,ছাগল,ভেড়া সবার বেলায়ও। তাই,ঘুমান্ত অবস্থায় কিভাবে ব্যায়াম করা যায়,তার একটা ব্যবস্থা গবেষকরা  করেছেন। শুধু আমি না,আপনিও এখন থেকে শুরু করতে পারেন। এটাতে আপনার দেহ,মন দুটাই ভাল থাকবে। আপনার মার্কেটিং জবে কোন কান্তিই পড়বে না। আমি তো এত জায়গায় ঘুরলাম,কই ঘুমান্ত ব্যায়াম নামে কোন ব্যায়াম আছে বলে শুনি নাই। আহা! দাদা বললাম না এটা নতুন বের হয়েছে। দাদা হঠাৎ কেমন জানি চুপসে গেল,আগের মত হাম্বি-তাম্বি তার কন্ঠে আর নাই। নরম গলায় আমার কাছে জিজ্ঞাসা করল,ভাই আপনার কি মনে হয়? আমি কোন উত্তর না দিয়ে হাসতে হাসতে বললাম,দাদা আপনি এখন আপনার রুমে যান,যেহেতু আপনি বাহির থেকে এসেছেন। আগে ফ্রেশ হন,পরে এসব বিষয় নিয়ে আপনার সাথে কথা বলা যাবে। দেখুন ভাই,আপনি কিন্তু বিষয়টা এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছেন। আহা! আমি বললাম তো পরে জানাবো। ঠিক আছে আপনার কথা মত এখন যাচ্ছি। আমার উত্তর কিন্তু আপনাকে দিতে হবে। তা না হলে হবে না কিন্তু। দাদা আর কোন কথা না বাড়িয়ে নিজ রুমে চলে গেল। এর মধ্যে হঠাৎ,আমার মোবাইলে রিং টোন বেজে উঠল,এই সময় আবার কার ফোন। ওহ! এ তো দেখছি কবি মির্জা ভাইয়ের ফোন। পেশায় লোকটি এ্যাডভোকেট তবুও শিল্প-সাহিত্যর প্রতি বিশ্বাস ও ভালবাসা তার অগাধ। হ্যাঁ,মির্জা ভাই কেমন আছেন? ভাল। আপনি কেমন আছেন? ভাল। তো হিমালয় সাহেব,আগামি শুক্রবার পাবলিক লাইব্রেরি মিলানয়তনে কবিতা পাঠের আসর বসবে। আপনি যদি অনুষ্ঠানটিতে উপস্থিত থাকতেন,তাহলে আমি খুব খুশি হতাম। কিন্তু এই মুহুর্তে আমি কোন কথা আপনাকে দিতে পারছি না। কারণ ঐদিন আমার ব্যক্তিগত কিছু কাজ আছে। যদি আমি সেইগুলি সময়মত শেষ করতে পারি,তাহলে অবশ্যই আপনার ওখানে যাব। না,না ওসব বললে তো হবে না। আপনাকে আসতেই হবে। আচ্ছা ভাই কথা দিচ্ছি না তবে আপ্রাণ চেষ্টা করবো। এবার বলুন তো,অন্য কবিরা কেমন আছে? ভাল,আপনি আসেন অনুষ্ঠানে ওরা ছাড়াও আরোও কিছু নতুন কবিদের সাথে আপনার পরিচয় ঘটিয়ে দিব। আচ্ছা,তাহলে এবার রাখি।

অফিসের চেয়ারে মুখ গুমড়া করে বসে আছে ইয়াদ আলী। মুখে কোন কথা নাই। কি ব্যাপার ভাই,আপনার দেখছি আজ খুব মন খারাপ। কোন ‘টু’ শব্দ নাই। এর মধ্যে আলী আহমেদ এসে হাজির। কি ব্যাপার,কি হয়েছে? আর বলেন না ভাই,আজ আমাদের ইয়াদ ভাইয়ের মুখে কোন কথা শোনা যাচ্ছে কেন? ওহ! এই ব্যাপার। এটাতো স্বাভাবিক কারণ,যার ঘরে বউ নাই,সে তো এমন করে থাকবেই। দেখেন আপনারা যদি চেষ্টা তদবির করে তাকে বিয়ে দেওয়াতে পারেন,তাহলে সব কিছু ঠিক হয়ে যাবে। তখন দেখবেন মুখে শুধু হাসি আর হাসি। আচ্ছা,এটাই যদি হয়ে থাকে তাহলে তো মেয়ে দেখা শুরু করতে হয়। শুনুন আলী ভাই, আপনি আজ থেকে মেয়ে দেখা শুরু করেন। আরে ভাই,ইনার জন্য অনেক আগে থেকে মেয়ে দেখছি,কিন্তু ইনার তো কাউকে পছন্দ হয় না। তাই,বলছি আপনি একটু দেখুন। ঠিক আছে আপনি যখন পারেন নাই,তখন আমি একটু চেষ্টা করে দেখি পারি কিনা।
দেখেন ভাই,দেখেন। আল্লাহ আপনার ওপর খুব খুশি হবেন। 
হঠাৎ,ইয়াদ আলী তার সমস্ত নীরবতা ভেঙ্গে মুখ খুলল,আচ্ছা আপনারা কি আমাকে বসতে দিবেন,কখন থেকে সেই দু‘জনে মিলে আমার কানের কাছে বকর,বকর করতেছেন। এবার একটু মুখে দয়া করে কুলুপ আটুন আর হিমালয় সাহেব আপনিও কি উনার মত করবেন? আহা! উনি খারাপ কি বললেন,বিয়ে-সাধির কথায় তো বলছেন,এটা তো ভাল কথা। তাছাড়া,আপনারও তো বয়স হয়ে যাচ্ছে। সময়ের কাজ যদি সময়ে না করেন,তাহলে পরবতীর্তে বিপদে পড়বেন। তাই বলি,যতদূর পারেন দ্রুত একটা কিছু করেন আর আমরাও অনেকদিন পর ভুরিভোজ খায়। আপনি আমাকে হাসালেন হিমালয় সাহেব। আমার জীবনে কখনও বিয়ে হবে কিনা তা জানি না। তবে,আপনি যখন চেষ্টা করা শুরু করেছেন,তখন দেখুন চেষ্টা করে। যদি আমার বিয়েটা হয়। কিন্তু আমি যদি চেষ্টা করি তাহলে,এখানে তো হবে না। হতে হবে সেই যশোরে,সেটা আপনি মানবেন কিনা এটা আমার সংশয়? আপনি যেখানেই বলবেন,আমি সেখানেই যাব। আমার এটা দৃৃঢ় বিশ্বাস আপনি আর যাহাই করুন আমার কোন ক্ষতি করবেন না। 
এরমধ্যে হঠাৎ আলী আহমেদ বলে উঠল,এই যদি হয় আপনার মনের ইচ্ছা,তাহলে আমাকে এত কষ্ট করালেন কেন? জানেন আপনার জন্য কত জায়গায় না আমি মেয়ে দেখেছি। এর স্বাক্ষি রাসেলও। পাশে দাঁড়ান রাসেলও এই কথায় সায় দিল। কি ব্যাপার ইয়াদ ভাই ঘটনা কি সত্য নাকি? এই কথা তো আলী ভাই আপনি কখনও আমাকে বলেন নি? কি আর বলবো ভাই,দেখেন আপনি যদি একটা বিয়া-টিয়া করিয়ে দিতে পারেন,তাহলে তো ভাল। আমি এখন এই ব্যাপারে আমার অপরাগতা প্রকাশ করছি। আর জানেন না ভাই,প্রায় গ্রাহক এসে আমাকে জিজ্ঞাসা করে,ইনি বিয়ে করেন না কেন,বিয়ে করলে উনার সমস্যা কি, উনার বয়সও তো বেড়ে যাচ্ছে,এসব নানা প্রশ্নের উত্তর দিতে দিতে আমার মুখ ব্যথা হয়ে গেল। কিন্তু উনার এসব দিকে কোন খেয়াল নাই। শুধু একের পর এক মেয়ে দেখেই যাচ্ছে। আল্লার দোহায়,উনারে বিয়ে-টিয়া কিছু একটা করিয়ে দিন তাড়াতাড়ি। কিন্তু আলী ভাই আমার কাছে তো কম গ্রাহক আসে না,তারা তো আমাকে কিছু বলে না। আরে ভাই,এই অফিসে ট্রান্সফার হওয়ার আগে এক সময় আমি জাজিরা শাখা অফিসে ছিলাম,আর তখন থেকে আমার যাতায়াত ছিল এই অফিসে আর সেই সুবাদে গ্রাহকরা আমাকে ভাল করে চেনে। তাই দাবী করে আমাকে সব অভিযোগ করে,আপনাকে বলবে কেন? আচ্ছা ঠিক আছে,আপনাকে কোন গ্রাহক আর কখনও কিছু না বলে সেই ব্যবস্থা করা যায় কিনা, দেখি একবার চেষ্টা করে।

আজ ক‘দিন হল তন্ময় স্পষ্ঠ করে আব্বু ও আম্মু কথাটা বলতে শিখেছে। তবে,যতটা আম্মু না বলছে,আব্বু বলছে তার দ্বিগুন। সাথে এটাও বলছে বারবার,আব্বু যাব,আব্বু যাব। অনন্যা এত বোঝাচ্ছে তোমার আব্বু তাড়াতাড়ি বাড়িতে আসবে। কিন্তু সে কোন কথাই শুনছে না। শেষ-মেষ না পেরে সে তার আব্বুর কাছে মোবাইল দিল। কি ব্যাপার,তোমরা কেমন আছো সবাই? আর বল না তোমার ছেলে তো আব্বু,আব্বু করে কান ঝালাপালা করে দিল। এখন তুমি তাকে একটু বুঝিয়ে বল। কি! সে স্পষ্ঠ আব্বু বলতে পারছে? আচ্ছা  তুমি মোবাইল ফোনটা ওকে দাও তো দেখি একবার। এই নাও,তুমি একটু বুঝিয়ে বল। আব্বু তন্ময় কি হয়েছে তোমার? সে তার মনের অভিব্যক্তগুলি শুধু আব্বু আর আব্বু বলে শেষ করতে লাগল। শোন আব্বু,আমি খুব তাড়াতাড়ি তোমার কাছে আসছি। আর আসার সময় তোমার জন্য অনেক খেলনা নিয়ে আসবো। আব্বু তুমি এবার আমাকে একটা চুমু দাও তো দেখি। ছোট,ছোট করে মোবাইলের স্ক্রীনে দুটি চুমু দিল। প্রতি উত্তরে,আমিও দিলাম অনেক। শুধু চুমু নয়,তার সাথে চোখের পানিও পড়তে লাগল মোবাইলের স্ক্রীনের ওপর টপ্ ,টপ্ করে। আব্বু,তুমি তোমার আম্মুর কাছে এবারে মোবাইলটা দাও তো দেখি। কি ব্যাপার,ছেলের সাথে আর কথা বলবে না? না ওর সাথে কথা বললে নিজেকে আমি কেমন জানি হারিয়ে ফেলি। এই হচ্ছে তোমার সমস্যা,এই জন্য তোমার ছেলের সাথে আমি কথা বলতে দিতে চাইনা। এবার চোখের পানি মুছো। আচ্ছা শুধু ছেলের খবর নিলে হবে,আমার খবর নিবে না,না সেটার কোন দরকার নাই? এটা তুমি কি বললে,তোমার খবর আমি না নিয়ে পারি। শোন,তুমি তো তোমার মনের কথা বলতে পার,কিন্তু সে তো কোন কিছু বলতে পারে না। তাই,তার জন্য একটু মনটা বেশি কাঁদে। তবে,আর মনে হয় বেশি দিন অপেক্ষা করতে হবে না। খুব তাড়াতাড়ি যশোরে আমার ট্রান্সফার হয়ে যাবে। দেখ যদি তোমার বদলিটা হয়,তাহলে তো এটা আমাদের জন্য খুবই ভাল খবর। আর আমিও তো এটাই মনে মনে চাচ্ছি বহুদিন ধরে। দেখ অনন্যা,সত্য কথা বলতে কি বর্তমানে ভালবাসার রঙধনু শুধু তুমি এঁকে,এঁকে চলো না আমার জীবনে,এখন তন্ময়ও আঁকে। তুমি যদি হও পাখি,সে হয় তবে পালক। তোমাদের দু‘জনের সমন্বয়ে ভালবাসার একটা পূর্ণরূপ প্রকাশ পায় আমার জীবনে। একজন ছাড়া অন্য জন আমার কাছে কল্পনাতীত। তাই,তো দূরে বসে তোমাদের এত দুঃখ-কষ্ট অনুভূতি হয় আমার হৃদয়ে। জানো,যখন আমি বাড়িতে আসবো,তখন আমি কত কিছুই না মনে মনে ঠিক করে রেখেছি,তা তুমি চিন্তাও করতে পারবে না। বলনা,কি করবে তুমি আসলে? শোন,আমার প্রতিটি অনুভূতিকে কত আমোদে না সাজাবো। এক একটির রূপ থাকবে ভিন্ন,ভিন্ন আদরের চাদরে মোড়া,যা তোমাকে নিয়ে যাবে অন্য জগতে,অন্য লোকে। আচ্ছা দেখা যাবে,আগে এসেই তো নাও। আচ্ছা,এবার তাহলে রাখি। আমার আবার বালতিতে ভিঁজিয়ে রাখা কাপড়গুলি কাচতে হবে। কি বললে,কাপড় কাচবে? কথাটা শুনা মাত্র অনন্যা হোঁ,হোঁ করে হেসে উঠল। কি ব্যাপার তুমি হাসছো কেন? না তোমার কাজের কথা শুনে। এখন ভাবছি বাড়িতে এসে যদি তুমি আমার কাপড়-চোপড় একটু কেচে দাও,তাহলে তো আমার আর কোন চিন্তাই রইল না। ওহ! তাহলে আমাকে নিয়ে তুমি এই চিন্তা করছো। হঠাৎ,অনন্যার শাশুড়ি ঘরের ওপাশ থেকে ডাক দিল। এই মা আমাকে ডাকছে,এবার রাখি।

দুই মাস আগে দাদাকে হিমালয় জানিয়ে দিয়েছিল,সে আর এই মেসে নয়,অন্য জায়গায় চলে যাবে। মুলতঃ কারণ ছিল,দাদা ও মেস সদস্যদের মেস পরিচালনার ক্ষেত্রে তাদের বানানো সব উদ্ভট আইন-কানুন ও কিছু অদ্ভুত আচারণ থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য তার এই মেস ত্যাগ। কিন্তু দাদা কিছুতেই আমাকে ছাড়ার পক্ষপাতি নয়,কারণ,তার অনেক স্বার্থ জড়িয়ে ছিল এই যাওয়াতে। সময় শেষ হওয়ার এক সপ্তাহ আগেও দাদা আমাকে শেষ অনুরোধ করল না যাওয়ার জন্য। তার ধারণা ছিল এবারও আমি আগের মত থেকে যাব। কিন্তু আমি যখন স্পষ্ঠ জানিয়ে দিলাম,আগামি সপ্তাহে মেস ত্যাগ করছি,তখন দাদার মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়ল। এরপর সে ছায়া শক্তি হিসাবে লেলিয়ে দিল মেস সদস্যদের। এখন আর মেসের সদস্যরা আগের মত আমার সাথে কেউ ভাল করে কথা বলে না। তাহলে কি স্বার্থ সংশ্লিষ্ট ব্যাপারই সব! আমার এত দিনের ভালবাসা,¯েœহ সবই বৃথা। মানুষ এত স্বার্থপর হয় কেন? তারা তো একটু সহজ হতে পারত,আর সহজ হলে বা কি ক্ষতি হত! তাতে আমি মনে করি আহা মরি কোন ক্ষতি হত না। আমাকে আটকে রাখলে,হয়ত মাসের শেষে তাদের খরচটা একটু কমতো আর দাদার লাভ হত ইংলিশ শিক্ষাটা। কিন্তু মজার ব্যাপার হচ্ছে,কি শিখাবো ইংলিশ তাকে। সে নিজে নিজে মনে করে,সে সব কিছু  জানে,বোঝে। তাহলে এখানে আমি কিবা করতে পারি! যাক,সেই সব কথা। তাদের ব্যাবহার-আচার এমন পর্যায় চলে গেল যে,আমাকে মাস শেষ হওয়ার আগেই উঠতে হল অফিস কলিগ ইয়াদ হোসেনের মেসে। এই মেসটি আবার ঐ রকম চার তলা বাসা নয়,টিন সেডওয়ালা বাসা আর সামনে একটা পুকুর। বস্তুত পক্ষে,শরীয়তপুরে বেশির ভাগ লোকের বাড়ি টিন শেডওয়ালা। আর এর সাথে সাথে শুরু হল,আমার জীবনের অন্য এক অধ্যায়। 

তন্ময় এ ঘর থেকে ও ঘরে যাচ্ছে মুখ দিয়ে গাড়ির শব্দ বের করে। কখনও থামছে,আবার কখনও জোরে ভুম.....ভুম শব্দ করে দৌঁড় দিচ্ছে। তাকে শত বাঁধা দেওয়ার সত্ত্বেও সে কোন কথা শুনছে না। আব্বু এভাবে করলে তো তুমি পড়ে যাবে। একটু থামো। আমার একটু কথা শোনো। না,তবুও তার গাড়ি চালানো থেমে নাই। মহা ঝামেলায় পড়লাম! না,এবার ওর আব্বু বাড়িতে আসলে একটি বেবি রিক্সা না কিনে দিলে নয়। এর মধ্যে অনন্যার শাশুড়ি এসে হাজির হল। কি হয়েছে বৌমা? আর বলেন না মা,আপনার নাতি দেখেন কিভাবে দৌঁড়াচ্ছে এ ঘর থেকে ও ঘরে। যদি একবার পড়ে যায়,তাহলে একবার ভাবুন তো কি হবে ওর? আরে না বৌমা,ছোট ছেলে-মেয়েরা যদি এ বয়সে একটু দৌঁড়া-দৌঁড়ি না করে,তাহলে কি তাদের হাড়-গোড় একটু শক্ত হয়। যত খেলা-ধুলা,দৌঁড়া-দৌঁড়ি করবে,ততই তাদের জন্য ভাল। এসব নিয়ে তোমাকে চিন্তা করতে হবে না আর তাছাড়া,ও যখন এত মুখ দিয়ে গাড়ি চালাচ্ছে,তখন একটা ওকে বেবি রিক্সা কিনে দিতে হবে। হ্যাঁ মা,আমিও সেটা ভাবছি। বৌমা,এদিকে এসো তো একবার রান্না ঘরের দিকে। সাথে সাথে তন্ময় বলে উঠল,রান.................রান। মানে,সেও রান্না করবে। ওর কান্ড-কারখানা দেখে শাশুড়ি-বৌমা হেসে কুটিকুটি হতে লাগল। দেখেন মা আপনার নাতি এখন বলছে,সেও রান্না করবে। অবশ্যই করবে আমার দাদু ভাই। শুধু কি রান্না,আরোও কত কিছু করবে। আমার বাজার করে দিবে,পান কিনে দিবে,সুপারি কিনে দিবে আরোও কত কি! বড় হলে আমাকে ডাক্তারের কাছেও নিতে হবে তোমায়। তন্ময় কোন কিছু না বুঝে ফোকলা দাঁত বের করে দিয়ে হাসতে লাগল। সেই সুযোগ বুঝে তার দাদী কোলে তুলে নিয়ে তার বুকে সুঁড়সুড়ি দিয়ে আরোও হাসাতে লাগল। দেখ বৌমা,তোমার ছেলে কি ফাজিল না হয়েছে? সাথে সাথে অতটুকু ছেলের শক্ত প্রতিবাদ। বলে উঠল,ফা.............। মানে,আমাকে ফাজিল বলা হচ্ছে। মূহুর্তের মধ্যে সে তার দাদীর কোল জুড়ে প্রসাব করে দিল। প্রসাবের পানি গড়িয়ে গড়িয়ে পড়াতে তার দাদাীর সমস্ত শরীর ভরে গেল। সাথে সাথে ওকে নীচেয় মেঝেতে নামিয়ে দেওয়া হল। সে নীচে নেমেই মায়ের কাছে লুকালো। তন্ময় তোমার দাদীকে তুমি একি করেছো! সে সামনের দুটি দাঁত বের করে একটু হাসল। তুমি তোমার দাদীকে সরি বলো। স................। মানে সরি। ওসব কথা রাখ বৌমা এবার। আচ্ছা,এর মাঝে কি তোমার সাথে হিমালয়ের কথা হয়েছে। জিঁ মা। কেন,এই কথা জিজ্ঞাসা করছেন কেন? না,মানে ছেলেটা আমার অনেক দিন হয়ে গেল বাড়িতে আসে না। কি বলেন মা! সে তো মাত্র মাসখানেক হল ওখানে গিয়েছে। তা নাই হল,কিন্তু তোমাকে কি কিছু বলে না,যে সে কবে যশোরে আসবে। না,মা তেমন কিছু স্পষ্ঠ করে বলে না। তবে,গত দুই দিন আগে বলেছিল,খুব তাড়াতাড়ি নাকি তার ট্রান্সফার হওয়ার সম্ভবনা আছে। আর সম্ভবনা! সেই কবে থেকে শুনছি তার ট্রান্সফার হওয়ার কথা। কিন্তু কই,কিছুই তো তার আলামত পাচ্ছি না। না মা এবার মনে হয়,সত্যই যশোরে বদলি হয়ে যাবে। কারণ,কি যেন একটা বলছিল। ওহ! মনে পড়েছে,বলছিল প্রধান কার্যালয় থেকে নাকি বদলি হওয়ার প্রায় সব কাজ সম্পূর্ন করে ফেলেছে । এখন নাকি যে কোন দিন বদলির অর্ডার হতে পারে। সত্য বলছো বৌমা! তাহলে তো এতদিন পর আল্লাহ আমার ছেলেকে ঘর মুখো করছে। এবার তার অনেক দিনের আশাও পূরণ হতে যাচ্ছে। তা কবে হবে এটা? তা স্পষ্ঠ করে বলিনি মা। তবে,এই মাসের শেষ দিকে অথবা সামনের মাসের প্রথমে। শোন বৌমা! ও আসলে একটু ঘাট কোলটা রাঁধবে কিন্তু। ও আবার ঐ শাঁকটা খুব পছন্দ করে। তুমি তো আবার ওটা রাঁধতে চাও না,হাত চুলকাবে বলে। তুমি যদি না রাঁধতে চাও,তাহলে আমাকে দিও আমি রাঁধবো। না মা,আপনার কষ্ট করতে হবে না,আমিই রেঁধে দিব। আগে সে বাড়িতে আসুক তো। আর কি যেন পছন্দ করে,ওহ! গরুর গোশত ওটাও তুমি রাঁধবে। জিঁ,মা এসব নিয়ে আপনাকে কোন চিন্তা করা লাগবে না। জানো বৌমা,একটা সময় ছিল,ওরা ভাই-বোনে মিলে এক সাথে খেতে বসতো। কি আনন্দই না করত! সময়ের পরিবর্তনের সাথে সাথে সব কিছুই এলোমেলো হয়ে গিয়েছে। সবাই এখন কাজে ব্যস্থ। খাওয়া তো দূরের কথা এক সাথে বসে গল্প করার সময়টুকু কারোও নাই। তোমার বড় ভাসুর আছে তার মত আর ছোট দেবর থাকে সেই ঢাকাতে। সেও যখন আসে,তখন এক থেকে দুই দিনের বেশি সে থাকতে চায় না এখানে। মোটামোটি কথা,এখন সবাই ব্যস্থ। আমি এখন উঠি। ওদিকে,আবার আছরের নামাযের আযান দিল। মা,একটা কথা বলতাম। বল। না বলছিলাম কি,আমি একটু আব্বুকে দেখতে বাপের বাড়ি যাব। তার নাকি শরীরটা বেশি ভাল যাচ্ছে না। আহা! যাবে। অবশ্যই যাবে। আগে হিমালয় আসুক। তারপর না হয় দু‘জনে মিলে এক সাথে যাবে। শোন,এসব নিয়ে এখন তোমাকে চিন্তা করতে হবে না। সময় আসুক ওটা পরে দেখা যাবে। এবার আমি যায়,ওদিকে আবার নামাযের সময় শেষ হয়ে যাবে। 

আজ আবহাওয়া এমন রূপ ধারন করেছে যে,অন্যান্য দিনের তুলনায় একটু বেশি ভাল। চারিদিকে কেমন রোদের আলো ঝকমক,ঝকমক করে আলোর জয় ধ্বনি তুলছে। অফিসের দরজায় পা রাখা মাত্র চোখে পড়ল টেলিফোন কিরিং,কিরিং করে বেজে চলেছে। কিন্তু ধরার কেউ নাই। অফিসের পিয়নও দেখছি নাই। না,আমাকেই ধরতে হবে। 
হ্যালো,কে বলছেন? জিঁ,আমি ফরিদপুর জোনাল হেড কোয়ার্টার থেকে বলছি। জিঁ বলুন। আমি হিমালয় সাহেবকে চাচ্ছিলাম। জিঁ,আমি হিমালয় বলছি। আপনার একটা সু-সংবাদ আছে। আপনার ট্রান্সফার হয়ে গিয়েছে যশোরে। আপনি যত তাড়াতাড়ি পারেন,অফিসের সব কিছু বুঝিয়ে দিন ও.আই.সি এর কাছে। আর যথা সময়ে আপনার ট্রান্সফার লেটার আপনার বরাবর চলে যাবে। কথা শেষ হওয়ার সাথে সাথে টেলিফোনটি রেখে দিলাম। আমি কথাটা শুনে বিহবল হয়ে গেলাম। এটা আমি কি শুনলাম! সত্যই আমি যশোর যাচ্ছি। সত্যই আমি তন্ময়কে কাছ থেকে আদর করতে পারবো। এ যে অবিশ্বাস্য মনে হচ্ছে আমার কাছে! এটাও কি সম্ভব! এখন আমার প্রথম কাজ হচ্ছে অনন্যাকে জানানো। সংবাদটা পেলে হয়ত সে লাফ দিয়ে উঠবে। এখন জানাবো,না পরে,না থাক,একটু পরেই জানায়। মানে সে বুঝতে পারছে না কোনটা করবে আর কোনটা করবে না। ¯্রষ্টার অপার কৃপা ছাড়া এটা সম্ভব না। তাই,প্রথমে তাকে জানাই অজ¯্র শুভেচ্ছা। জীবনের ধারাপাতই বুঝি এ রকম! আলো আঁধারের গহিন মিশ্রন। এটা আমাদের মত সাধারণ মানুষের পক্ষে বুঝা তা সম্ভব নয়। কি বিচিত্রই না জীবন! তাই,আমরা না বুঝে,না ধৈর্য ধারন করে ঝটপট সিদ্বান্ত নিয়ে ফেলি,যার বেশির ভাগই ফলাফল হয় আমাদের বিপক্ষে। এর মধ্যে হঠাৎ,ইয়াদ হোসেন পিছন থেকে কাঁধে হাত রাখল। কি ব্যাপার হিমালয় সাহেব,আপনাকে আজ খুব খুশি,খুশি মনে হচ্ছে। হ্যাঁ,আপনি ঠিকই ধরেছেন। তো খুশির কারণটা কি আমি জানতে পারি? অবশ্যই। তাহলে শুনুন,আমার যশোরে ট্রান্সফার হয়ে গিয়েছে। কি বলেন! কোন চিঠি কি হাতে পেয়েছেন? না। তাহলে? এইমাত্র ফরিদপুর জোনাল হেড কোয়ার্টার থেকে আমাকে ফোনের মাধ্যমে জানিয়েছে। তাহলে তো ঠিক আছে। দেখুন হিমালয় সাহেব,বিষয়টা আপনার জন্য খুশির সংবাদ হলেও আমার জন্য দুঃখের। কারণ,আপনাকে এখানে নিয়ে আসার জন্য কতই না কষ্ট করেছি আমি। এখন যদি আপনি এখানে না থাকেন,তাহলে প্রত্যক্ষ-পরোক্ষভাবে আমাকে আপনার সব কাজ করতে হবে আর এ ব্যাপারে আমাকে সাহায্য করারও কেউ নেই। কেন আলী আহমেদ সাহেব আছেন না? দূর,আপনি আর লোক খুঁজে পেলেন না। সে না এস.ও,দেখেন না তার ভাব কত! এস.ও হয়ে মনে করে পৃথিবীতে তার ওপরে আর কেউ নাই। দেখেন না,একটা কাজের কথা বললে,আর একটা বলে বসে। আমি আছি বড়ই বিপদে! তারপরও যান,আপনি ভাল থাকবেন,সুন্দর থাকবেন। পারলে আমার জন্য একটু দোয়া করবেন। সবই ঠিক আছে ইয়াদ ভাই। তবে,বলি কি এক সাথে কাজ করলে অনেক কিছু হয়,কিন্তু তাই বলে সব কিছু মনে রাখলে চলে না। এমন সময় দেখতে পেলাম,আলী আহমেদ ভাবের সহিত আমাদের দিকে হেঁটে আসছে। দেখেন ভাই,আপনি যে বলছেন মিলে-মিশে থাকবো,ওর অবস্থাটা একবার ভাল করে দেখেন। কি ভাবই না তার চলন-বলনে! আমার মাঝে মাঝে মনে হয় কান পেঁচিয়ে যদি একটা থাবা দিতে পারতাম ওকে,তাহলে আমার মনের জ্বালাটা একটু হলেও মিটতো। কি বলেন ইয়াদ ভাই,অফিসে এসব কথা বলা ঠিক না। 
কি ব্যাপার,সবাই এখানে দাঁড়িয়ে কি কথা হচ্ছে? মনে হচ্ছে কোন খবর-টবর আছে। জিঁ,আপনার অনুমানই সত্য। আমার ট্রান্সফার হয়ে গিয়েছে যশোরে। আলী আহমেদ এর মুখে কোন কথা নাই। শুধু ভাল বলে নিজের চেয়ারে গিয়ে বসলো। দেখছেন ভাই,ওর কান্ড-কারখানা! থাক ওসব। চলুন,আমরা অফিসের কাজে মনোযোগ দেয়। 

মেসে এসে বিছানার উপর শুয়ে শুধু ভাবছি,কিভাবে অনন্যা,তন্ময় ও মাকে এখনই বদলির খবরটা জানানো যায়। না জানি,খবরটা শুনলে ওরা কত খুশি না হবে। এই দিনটার জন্য সবাই কত আগ্রহ করেই না বসে আছে! কত রাত,কত দিন প্রতিক্ষায় থেকেছি,শুধু আমি না ওরাও। তবে,বিশেষ করে তন্ময়। শুধু বাবার স্পর্শের অনুভূতি প্রতিটিক্ষণ তাকে তাড়া করে নিয়ে বেড়াচ্ছে। যদি সে এখন বুঝতে পারে,তার বাবা সব সময়ের জন্য তার কাছে থাকবে,তাকে আদর করবে আরোও অনেক। সেই মনের ব্যাকুলতা বুঝে,নিজের অজান্তে অন্য এক রোমাঞ্জ অনুভূতি হল আমার মনে। আর অনন্যা ও মার কথা নাই বাদই দিলাম। আর কোন ভাবনা নয়,দেখি ওরা কি করছে এবং এই মূহুর্তে ওদেরকে এই খবরটা জানানো খুব প্রয়োজন। মোবাইলে কল করার সাথে সাথে ওপাশ থেকে ফোনটা বেজেই যেতে লাগল। কিছুক্ষণ পর অনন্যা ফোনটি রিসিভ করল। কি ব্যাপার,সাহেবের কি সূর্য আজ পশ্চিম দিক থেকে উঠল নাকি? ঐরকমই। বাহ! সাহেবের মনে তো বেশ আনন্দই দেখছি। ঘটনাটি কি আমি জানতে পারি? অবশ্যই জানতে পার। শোন,আমি তোমাকে এখন যে খবরটা দিব,শুনলে তুমি লাফ দিয়ে উঠবে। কি এমনি খবর যে আমি লাফ দিয়ে উঠবো। আগে বল দেখি,তোমার ঘটনাটি। আচ্ছা,তুমি অনুমান করে বল তো কি হতে পারে? কি আর হবে। হয়ত প্রমোশন-টমোশন হয়েছে তোমার। এছাড়া আবার কি। তোমার অনুমান সঠিক নয়,আরও একবার সুযোগ দিলাম। আচ্ছা যাও আমি পারলাম না। এবার তুমি বল। শোন তাহলে এবার,আমার ট্রান্সফার হয়ে গিয়েছে যশোরে। কি বল তুমি! সত্য বলছো কথাটা। আমার কথাটা বিশ্বাস করতে কেমন কষ্ট হচ্ছে। এটাও কি সম্ভব! তুমি না কিছু দিন আগে বলেছিলে তোমার খুব তাড়াতাড়ি ট্রান্সফার হবে,কিন্তু এত শিঘ্রই হবে,এটা ছিল আমার কল্পনাতীত। সত্যই এত দিন পরে তুমি একটা ভাল সংবাদ দিলে আমাকে। আচ্ছা,এখন ফোনটা রাখি। তন্ময় ও মাকে এক্ষুণিই খবরটি জানাতে হবে। অনন্যা ফোনটি রেখে বিছানায় বসে থাকা তন্ময়কে নিয়ে আনন্দে লাফাতে লাগল। তন্ময় কিছু না বুঝে ফোঁকলা দাঁত বের করে দিয়ে হাসতে লাগল। তন্ময় তোমার আব্বু আসছে। ‘আব্ব’ু কথাটা শুনে ওর মনে হল সে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ শব্দটি শুনেছে। তারপর থেকে শুধু আব্বু,আব্বু করে চলেছে। পাশের ঘর থেকে তন্ময়ের দাদী হাঁক ছেড়ে বলল,কি ব্যাপার মা ছেলেতে এত খুশি কিসের? মা,খবরটা শুনলে আপনিও খুশি না হয়ে পারবেন না। কেন,শুনি কি এমন খবর তোমার? মা,আপনার ছেলে যশোরে ট্রান্সফার হয়ে গিয়েছে। কি বল বৌমা! কিন্তু তুমি যে বললে এই মাসের শেষের দিকে অথবা সামনের মাসের প্রথম দিকে হবে। সেটাতো আমারও কথা। তাহলে এত তাড়াতাড়ি হল কি করে! যাক,এতদিন পরে আমাদের দুঃখের পালা শেষ হল। আচ্ছা বৌমা,কবে আসছে সেই ব্যাপারে কোন কিছু বলেছে? না,তবে কথায় যা বুঝলাম দুই-তিন দিনের মধ্যে। এত দিন কেন? আহা! মা অফিসের কাগজ-পত্র সব কিছু বুঝিয়ে দেওয়ার পরই তো সে আসবে। এর মধ্যে পিছন থেকে তন্ময় তার দাদীর শাড়ির আঁচল ধরে টানতে লাগল। কি হয়েছে তোমার? আমার আব্বু,আব্বু। অর্থ্যাৎ,আমার আব্বু আসছে। ও তোমার আব্বু আসছে। দেখ বৌমা, তোমার ছেলেও খুশিতে আটখানা হয়ে গিয়েছে। যায় দেখি,কোনখানে ওর প্রিয় শাক ঘাটকোল,গরুর গোশত পাওয়া যায় কিনা। অনেক দিন পর ছেলে আমার বাড়িতে ফিরছে। 

তিন দিন পর আমি সমস্ত জিনিস-পত্র গুছিয়ে নিয়ে বাড়ির দিকে রওনা হওয়ার জন্য বাস ষ্টান্ডে হাজির হলাম। বিদায় লগ্নে রেখে যাওয়া কিছু স্মৃতি আমাকে পোড়াতে লাগল। কবিদের আড্ডা,দৈনিক পত্রিকায় লেখালেখি। কবিদের মধ্যে অন্যতম কামাল মল্লিক,মির্জা ভাই,মেহেদি ভাই,কোহিনুর আপা ছাড়াও অন্য কিছু কবি বন্ধু,যাদেরকে ভোলার মত নয়। আরোও ভোলার মত নয়,ছোট্র শহরের পাখির গান,কিচির-মিচির শব্দ। শুনসান নীরবতা ছাড়াও জলাশয়ের বড় বড় গুঁই সাপ,আঁকা-বাকা পথ তাকে বারবার কেন জানি ডাকছে। বিদায় বেলায় কবি কামাল মল্লিক,মির্জা ভাই সবার চোখে ছিল বেদনার জল। আমি পারিনি মুছাতে এ জল। বলতেও পারিনি কোন কিছু তাদের শুধু চেয়ে চেয়ে দেখায় ছিল আমার কাজ। তবুও কামালকে জাড়িয়ে ধরে বলেছিলাম,তুমি কাঁদছো কেন? আমি তো চলে যাচ্ছি না,আমি তোমাদের মাঝে আছি,থাকবো চিরদিন। আমি অবশ্যই তোমাদের সাথে যোগাযোগ রাখবো। তারপরও এ সাস্ত¡না যেন যথেষ্ঠ নয়। বেদনার গহীন তল ¯্রােত নীরবে বয়ে যাচ্ছিল আমার ভিতরে। ওদিকে বাস ছাড়ার সময় ঘনিভূত হতে লাগল। একটা সময় সব কিছুর অবসান ঘটিয়ে যশোরের উদ্দেশ্য ‘ফেম’ নামক বাসটি চলতে শুরু করল। আর সাঁই,সাঁই করে ফেলে যেতে লাগল অন্য সব গাড়িগুলি। সাথে সাথে ফেলে যেতে লাগল দোকান-ঘাট,ঘর-বাড়ি,কোর্ট,পরিচিত বাজার,আড়িয়াল খাঁ নদী। আমার এসব কিছু ফেলে যাওয়ার একটাই উদ্দেশ্য ছিল,আর সেটা হল তন্ময়ের কাছে ফিরে যাওয়া,আমার রক্তের কাছে ফিরে যাওয়া,আমার স্বজনদের কাছে ফিরে যাওয়া।




 

কোন মন্তব্য নেই

Blogger দ্বারা পরিচালিত.