বিশ্ব জুড়ে বাংলা সাহিত্যের সম্ভার

বিশ্ব জুড়ে বাংলা সাহিত্যের সম্ভার

সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ও সমালোচনা সাহিত্যে ‘হোরেস’ / শাহরিয়ার সোহেল



সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ও সমালোচনা সাহিত্যের প্রাণ পুরুষ হোরেস। যার পুরো নাম ছিলো কুইন্টাস হোরেসিয়াস ফ্যাককাস। ধারণা করা হয়, তার জন্ম খিস্ট পূর্ব ৬৫ অব্দের ৮ ডিসেম্বর ইটালীর এপুলিয়া প্রদেশের অন্তর্গত ভেনুশিয়া নামক স্থানে। ল্যাটিন সাহিত্যের সর্বশ্রেষ্ঠ গীতি প্রতিভা ও ল্যাটিন সমালোচনা সাহিত্যের আঁধার ঘরের মানিক হোরেস এপুলিয়াবাসী নাকি লুকানিয়াবাসী এ নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। যত দূর জানা যায়, হোরেসের পিতা ছিলেন একজন ক্রীতদাস। তিনি কীভাবে ক্রীতদাসে পরিণত হন, সে সম্পর্কে বিশেষ কিছু জানা যায় না। তবে পরবর্তীতে তিনি স্বাধীনতা প্রাপ্ত হন। সে ত্রে থেকে জানা যায়, হোরেস ক্রীতদাস ছিলেন না। তবুও তাকে এজন্য বহু তাচ্ছিল্য ও বিদ্রুপ সহ্য করতে হয়েছে। হোরেস এর লেখায় তার মায়ের সম্পর্কে তেমন কিছু পাওয়া যায় না, যদিও তার বাবার প্রতি হৃদয়-নিঃসৃত আবেগ সমৃদ্ধ ভাষায় কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করেছেন। তার বাবার প্রতি তার ছিলো একান্ত শ্রদ্ধাবোধ ও গভীর মমতা মাখানো ভালোবাসা। হোরেসের স্বাভাবিক প্রাকৃতিক সৌন্দর্য চেতনার স্বাক্ষর তার রচিত ‘ওড’গুলোতে বেশী পাওয়া যায়। দুর্দান্ত পার্বত্য নদী অফিদাস এর কল গর্জন প্রায়ই ধ্বনিত হয়েছে তার কবিতায়। সমুদ্র তরঙ্গের সাথে তার ছিল নিবীড় সম্পর্ক।

মনুষ্য সভ্যতার ইতিহাসে প্রাচীন গ্রীস ও রোমের অবদান অপরিসীম। গ্রীস জগৎকে উচ্চাঙ্গের দর্শন ভাবনা, মহাকাব্য ও ট্রাজেডির উত্তুঙ্গ শিল্প মাধ্যম, প্রকৃতির রহস্য উন্মোচনের পথ নির্দেশ, স্থাপত্য-ভাস্কর্য-চিত্রকলার সৌন্দর্য ও আনন্দলোকের যাত্রী হয়ে অমরত্ব আস্বাদনের প্রেরণা উপহার দিয়েছে। রোম বিশ্বকে উপহার দিয়েছে মানুষের বাস্তব জীবনকে আরও সুসংহত ও প্রাঞ্জল করে গড়ে তোলার জ্ঞান ও চিন্তা প্রসূত কর্মকান্ড। রোমানরা উদ্ভাবন করেছে প্রকৌশল বিদ্যা, গৃহ নির্মাণ, শিল্প, চিকিৎসাশাস্ত্র, কৃষিবিদ্যা, আইন ও রাষ্ট্রীয় প্রশাসন বিধি। গ্রীকরা তত্ত্বীয়ভাবে এগিয়ে থাকলে রোমানরা এগিয়েছে বাস্তব নির্ভর ও উপভোগ্যভাবে। আলেকজান্ডারের মৃত্যুর কয়েক শতাব্দীর ভেতরে গ্রীক জাতির অবনতি হলেও রোমানরাই গ্রীক-সংস্কৃতির ঐশ্বর্য ভান্ডারকে সংরণের দায়িত্ব গ্রহণ করে। রোমান ভাষা ও সাহিত্য কালক্রমে ঐশ্বর্যশালী হয়েছে। ফলশ্রুতিতে ইউরোপীয় ভাষা ও সাহিত্যে গ্রীকদের চেয়ে রোমানদের প্রভাবই বেশী হয়ে ওঠে। যদিও হোমারের মতো মহাকবি, ইস্কিলাস, ইউরিপিডিস, সফোকিসের মতো ট্রাজেডি রচয়িতা ল্যাটিন সাহিত্যে জন্মেনি, তথাপি কাব্য ও সমালোচনা সাহিত্যে ইন্নিয়াস, লুসিলিয়াস, লুক্রেসিয়াস, ক্যাটুল্লাস, ভার্জিল, ভেরিয়ূস, হোরেস, ওভিড উল্লেখযোগ্য। এছাড়াও যারা স্মরণীয় হয়ে আছেন, তাদের ভেতরে রয়েছেন প্লটাস, টেরেন্স, সেনেকা, সীজার, সেল্লাস্ট, লিভি, টেসিটাস প্রমুখ। সাহিত্য সমালোচনার েেত্র আঁধার ঘরের মানিক হিসাবে জ্বলজ্বল করছেন সিসেরো, হোরেস ও কুইন্টিলিয়ন। রোমে গ্রীক প্রভাব প্রবলতর হয়ে ওঠে। রোমক কবি-সমালোচক হোরেস আগাস্টাস সীজারের উদ্দেশ্য লিখেছিলেন।


কুইন্টাস হোরেসিয়াস ফ্যাককাস ওরফে হোরেস ছোট বেলা থেকেই প্রতিভাবান ছিলেন। অসাধারণ মেধা শক্তি ছিল তার। ছোট বেলা থেকেই শিল্প-সাহিত্যের প্রতি তাঁর আন্তরিকতা প্রকাশ পায়। তারুণ্যে ‘ট্রিবিউন’ হিসেবে তিনি যুদ্ধে যোগদান করেন এবং শোচনীয়ভাবে যুদ্ধে পরাজিত হয়ে কোন রকমে আত্মরা করতে সম হন। পরে দেশান্তরিত হয়ে আবার সাধারণ মার সুযোগ পেয়ে দেশে নিঃস্বভাবে ফেরেন। তাদের রোমের সম্পত্তি সকল বাজেয়াপ্ত ঘোষণা করা হয়। বাধ্য হয়েই এক প্রকার লেখনী ধারণ করেন। ভাগ্যের কাল মেঘ সহসাই কেটে যেতে লাগল। রোমের কোয়েস্টার এর অফিসে একটি কেরানীর পদে চাকরীর সুযোগ পান; এবং হোরেসের পৃষ্ঠপোষক ও সর্বশ্রেষ্ঠ বন্ধু মেসিনাস এর সহযোগিতায় সমকালীন রোমের দুই খ্যাতিমান কবি ভার্জিল ও ভেরিয়ুসের বন্ধুত্ব লাভ করেন। পরবর্তীতে প্রভাবশালী ব্যক্তিত্ব পল্লিও, এগ্রিপ্পা এবং সর্বশেষ স্বয়ং স¤্রাট ও দার্শনিক অগাস্টাস এর সংস্পর্শে আসেন। এক সময় অগাস্টাস তাকে ব্যক্তিগত সচিব হবার আহ্বান জানালেও হোরেস তাকে সবিনয়ে ফিরিয়ে দেন। মেসিনাস এর বন্ধুত্বই হোরেস বেশী উপভোগ করতেন এবং ধূলি- ধূসরিত, কল-কোলাহল মুখরিত রোমের চেয়ে সেবাইন খামারের নির্জনতাই তাকে বেশী আকৃষ্ট করত। কবি হিসাবে তিনি ক্রমাগত প্রতিষ্ঠিত হয়ে উঠছিলেন। ‘ইপোড’, ‘স্যাটায়ার’, ‘ওড’ প্রভৃতি রচনায় তিনি ছিলেন সিদ্ধহস্ত। হোরেস অত্যন্ত নিখুঁতভাবে ছন্দের গাঁথুনিতে তার কাব্যগুলোকে সমৃদ্ধ করেছেন। এর স্বপে তিনি দাবি করেছেন,


রোমের শ্বেত-মর্মর প্রস্তরে তৈরী রাজ প্রাসাদ এবং মন্দিরগুলির অপরূপ সৌন্দর্য ম্লান হয়ে ধ্বংসস্তুপে পরিণত হয়েছে। অথচ সে বিষয়গুলি সম্পর্কে লিখিত ‘ওড’গুলি আজও জীবন্ত এবং ধাবমানভাবে উজ্জ্বল। গীতি কবিতা রচনায় হোরেসের শৈল্পিক সাফল্য সর্বকালের কবিদেরই আকাক্সিক্ষত বিষয়। তিনি খুব সহজেই লেখার মাধ্যমে পাঠকদের আকৃষ্ট করতে পারতেন। তার আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্ব অন্যকে সহজেই মোহিত করত। তার ব্যক্তি চরিত্রের বেশিষ্ট্যের ভেতর রয়েছে অপূর্ব বন্ধু বৎসলতা, পরনিন্দা ও কুৎসা রচনার প্রতি সুতীব্র ঘৃণা বোধ, সুগভীর স্বদেশ প্রীতি, হিউমারবোধ, গল্প বলার সহজাত মতা এবং মাত্র গুটিকয়েক শব্দে একটি দৃশ্যকে মানুষের চোখের সামনে স্পষ্ট করে তুলে ধরার অনায়াস সামর্থ্য। সম্ভবত এসব বৈশিষ্ট্যের জন্যই তার মৃত্যুর প্রায় দু’হাজার পচাত্তর বছর পরেও সকল পাঠক তাকে আপন করে পেতে চায়। হোরেস সংযম অভ্যাসের মাধ্যমে সুখী জীবনের চাবিকাঠি খুঁজে পেয়েছিলেন। তিনি এই সিদ্ধান্তে পৌঁছেছিলেন যে, ‘মানুষের সকল অশান্তির মুলে রয়েছে অর্থের প্রতি তার মাত্রাতিরিক্ত লোভ, মনগড়া মিথ্যা ধারণার বশ্যতা এবং কুসংস্কার জনিত নিদারুণ মানসিক ভীতি।’ হোরেস সম্পর্কে সমালোচকগণের রায় হলো, তার রচনায় ‘লুক্রেসিয়াসের শৈথিল্য, ক্যাটুল্লাসের বাহুল্য, প্রোপাটিয়াসের কৃত্রিমতা, ভার্জিলের অতি গম্ভীরতা, ওভিদের আত্মাভিমান, তিবুল্লাসের বিষাদ, লুকানের পান্ডিত্য, পারসিয়ুসের অস্পষ্টতা, জুভেনালের কুরুচি’-ইত্যাদি দোষ-ক্রুটি অনুপস্থিত। হোরেস ভার্জিলের মতো ‘সড়ংঃ ৎবাবৎবফ' কবি না হয়েও ‘সড়ংঃ নবষড়াবফ' কবি হতে পরেছেন। রোমের সর্বশ্রেষ্ঠ গীতিকবি হিসাবে তিনি প্রতিষ্ঠিত।

সমালোচনা সাহিত্যে সিসেরো বেশ পারদর্শিতা দেখিয়েছেন। সে সময় রোমানরা কাব্যচর্চার বদলে বক্তৃতায় পারদর্শী হবার জন্য অধিক চেষ্টা করতেন। তারা মনে করতেন,.  প্রথম রোমান সাহিত্য সমালোচক মহা পন্ডিত বাগ্মী সিসেরো ছিলেন বক্তৃতা কলায় মহাপারদর্শী। সিসেরো ভাল বক্তৃতার যে সব গুণ থাকা অত্যাবশ্যক বলে মনে করেন, তা হল,  .সিসেরো বক্তৃতা কলার জন্য যা যা মনে করতেন, তা সাহিত্য-শিল্পের জন্যও প্রযোজ্য। সিসেরোর উক্তি ঃ
ল্যাটিন সমালোচনা সাহিত্যের প্রকৃত সাহিত্য সমালোচক হোরেস বক্তৃতা কলার আলোচনার ক্ষেত্র থেকে সমালোচনাকে বিশুদ্ধ সাহিত্যালোচনার েেত্র সরিয়ে আনেন। ষান্মাত্রিক ছন্দের কলা-কৌশলের ওপর হোরেস বিশেষ আলোচনা করেন। হোরেস এর অৎং ঢ়ড়বঃরপধ সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য সমালোচনামূলক রচনা। হোরেস ছিলেন কবি-সমালোচক, শুধু কবি বা শুধু সমালোচক নন। হোরেস বিচ্ছিন্নভাবে সমালোচনামূলক বক্তব্য সম্বলিত কিছু কবিতা বা কাব্য রচনাও করেন। সেগুলি সম্পূর্ণ বিশুদ্ধ কিনা এ বিষয়ে বিতর্ক থাকতে পারে। হোরেস এর সমালোচনামূলক রচনা সুনির্দিষ্ট ল্যাভিসারী ছিল।হোরেস এর সমালোচনায় আ্যারিস্টটলীয় সাহিত্য দর্শনের প্রভাব সুস্পষ্ট। তে  হোরেস তার ব্যক্তিগত সাহিত্য চিন্তার স্বার রেখেছেন। ভাল কবিতার লণ কী এবং কবি সম্পর্কে হোরেস তার নিজস্ব মত ব্যক্ত করেছেন। তার ওড জাতীয় কবিতাগুলিতে লণীয় মৌলিকতা রয়েছে। হোরেস এর সমালোচনা মূলক বক্তব্যের সাধারণ বৈশিষ্ট্যের ভেতর রয়েছে;

ক. হোরেস সর্বত্রই তাঁর সাহিত্য-সম্পর্কিত বক্তব্য কল্পনা সমৃদ্ধ কবিতার আঙ্গিকে সন্নিবেশিত করেছেন।
খ. হোরেসের সাহিত্য সমালোচনা একজন কবি-সমালোচকের ভাবনা জগতে সঞ্চরণশীল কিছু নিয়ম নিষ্ঠ বক্তব্য; কোনো পরিকল্পিত সমালোচনা বিধি প্রণয়নের দিকে ল্য রেখে এগুলো প্রকাশ করা হয়নি। এগুলোতে মুখ্যতঃ তার রচনায় প্রতিফলিত কতকগুলো বৈশিষ্ট্যকে স্বচ্ছভাবে, নির্দিষ্ট করে সঙ্গত ব্যাখ্যাসহ তুলে ধরা হয়েছে। এগুলো তাঁর কবিতার চারিত্র্য নির্দেশ যেমন করে, তেমনি অপরাপর কবির সঙ্গে তার মতের ঐক্য ও পার্থক্য নির্দেশ করে।
গ. হোরেস এই সমালোচনামূলক রচনাগুলোতে রোমান সাহিত্য সমালোচনার ঐতিহ্যবাহী প্রাচীন আধারেই কাব্য সম্পর্কিত সযতœ পোষিত কতকগুলো ব্যক্তিগত প্রিয় ধারণা ও বিশ^াস উপস্থাপিত করতে চেয়েছেন।
ঘ. কবিতার অনেকগুণ তার সমালোচনার পরিধিতে ধরা না দিলেও সমালোচনামূলক বক্তব্যের অনেক ফাঁকই পূরণ করে দিয়েছে কল্পনা সমৃদ্ধ কাব্যাঙ্গিক।
ঙ. হোরেসের সমালোচনামূলক রচনার সর্বত্রই কবিতার পে অবশ্য প্রয়োজনীয় যে সব গুণ থাকা দরকার সেগুলোকে যথাযথভাবে চিহ্নিত ও বর্ণনা করার ইচ্ছা প্রকট দেখা যায়। পদ্য ও কবিতার পার্থক্য নির্ণয়েও তিনি সদাতৎপর ছিলেন।

হোরেস এর পর সেনেকা সাহিত্য সমালোচনার বিষয়ে কিছুটা তৎপরতা দেখিয়েছেন। সেনেকা বলেছেন, হোরেস এর পরে শ্রেষ্ঠ রোমান সমালোচক কুইন্টিলিয়ান। তিনি মূলত পূর্বসূরী সিসেরোর বাগ্মিতা সম্পর্কে আলোচনা করেছেন। তবে রোমান গীতি কবিদের মধ্যে হোরেসই একমাত্র কবি যার রচনা বিশেষভাবে শৈল্পিক, কাব্য-সৌন্দর্য্যরে মনি কাঞ্চন সংযোগ রয়েছে এখানে। অবশ্যম্ভাবী, অপরিহার্য শব্দের উদ্ভাবন ও প্রেেয়াগ মতার বিষয় তিনিই প্রথম প্রকাশ করেছেন। খ্রিস্টীয় ত্রয়োদশ শতাব্দীতে রেনেসাঁসের বার্তাবাহী মহাকবি সমালোচক দান্তের আবির্ভাবের পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত হোরেস এর একচ্ছত্র আধিপত্য ল্যযোগ্য।

হোরেস এর অৎং ঢ়ড়বঃরপধ - সম্ভবত: খ্রিস্টপূর্ব ১২ থেকে ৮ অব্দের মধ্যে পদ্যের আকারে রচিত একটি পত্র মাত্র। জনৈক যুবককে সহসা কোন লেখা ছাপাতে নিষেধ করে এই পত্র রচিত হয়। এই যুবক হয়ত বা পিসোর জ্যেষ্ঠ পুত্র। ৪৭৬ পঙক্তি বিশিষ্ট এই উপদেশ মূলক পত্রখানি পববর্তীতে অৎং ঢ়ড়বঃরপধ নামে পরিচিত হয়। এখানে নাটক সম্পর্কেই অধিক মতামত ব্যক্ত করা হয়েছে। কবিতার রচনা শৈলী সম্পর্কেও নিজস্ব স্বাধীন মতামত ব্যক্ত করেছেন। তিনি বলেছেন, ‘শুধু স্বাভাবিক কবি প্রতিভা থাকলেই চলবে না, রচনাকারীকে পঠন-পাঠনে বিশেষ প্রযতœ নিতে হবে এবং নিয়ম-শৃঙ্খলা মেনে চলতে হবে। সাহিত্যিক সার্থকতা নির্ভর করে প্রকৃতি প্রদত্ত প্রতিভা ও শৈল্পিক কলা-কৌশল প্রয়োগের দুর্লভ মতার সমন্বয়ের ওপর। কোন রচনা প্রকাশের আগে কবিকে তা সমালোচকের সু¥াতি-সু¥ বিচারের জন্য তার কাছে পেশ করতে হবে এবং অত্যন্ত সতর্কভাবে পরিমার্জনা না করে কোন রচনা প্রকাশ করা ঠিক হবে না।’ হোরেস গ্রীক সূত্র থেকে এবং পূর্বগামী সিসেরোর বক্তব্য থেকে উপকরণ গ্রহণ করেছিলেন। সাহিত্যের বৈশিষ্ট্যের ভেতর ঐক্য, সামঞ্জস্যবোধ, সঙ্গতি, সত্যসন্ধতা, সুস্থ-চিন্তা ও শৈল্পিক প্রযতœশীলতা থাকা বাঞ্চনীয় বলে তিনি মনে করতেন। তিনি অ্যারিস্টটলের ন্যায় কবিতাকে অনুকরণাত্মক শিল্প হিসেবে মনে করেন নি। তবে উৎপত্তির মূলে অনুকরণের প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে বলেছেন। হোরেস বলেছেন, ‘কবিদের জন্য আমি এই অবশ্যপালনীয় সুত্র নির্দেশ করছি যে, অভিজ্ঞ কবি অনুকারী শিল্পী হিসেবে সর্বদাই আদর্শের জন্য মনুষ্য জীবন ও চরিত্রের দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করবেন এবং তা থেকে জীবনের সত্যিকার রূপের ব্যঞ্জনা দিতে সমর্থ ভাষা-ভঙ্গি আবিষ্কার করবেন। কবিরা হয় আনন্দ, নয় উপযোগের দিকে ল্য রাখেন অথবা আনন্দ ও উপযোগের সমন্বয় ঘটান। যে ব্যক্তি আনন্দের সঙ্গে উপযোগের সার্থক সমন্বয় ঘটাতে পারেন, তিনি সকলের প্রশংসা পেয়ে থাকেন। কারণ তিনি পাঠককে আনন্দ দেয়ার সঙ্গে সঙ্গে সুস্থ জীবন প্রদায়িনী নীতি শিাও দিয়ে থাকেন।’ পাশাপাশি তিনি কল্পনা-প্রবনতার বিষয়টিকেও গুরুত্ব দিয়েছেন। রেনেসাঁস আমলে সমালোচকদের কন্ঠে এই সব মন্তব্য বার বার প্রতিধ্বণিত হয়েছে। কবিতা রচনার ব্যাপারে উপযুক্ত ও যথার্থ বিষয় নির্বাচনের প্রয়োজনীয়তা এবং উপযুক্ত বিশুদ্ধ ভাষা-শৈলী ও ছন্দোমাত্রা নির্বাচনের প্রতি গুরুত্ব আরোপ করেছেন। তিনি কবিতার রচনাভিলাসীদের উদ্দেশ্যে বলেছিলেন, ‘গ্রীক সাহিত্যাদর্শের  অনুশীলন ও অনুধ্যানই হওয়া উচিত তোমাদের দিন-রত্রির সাধনার বিষয়’। হোরেস মনে করতেন, ‘রচনার প্রতি অংশকে প্রতি দিককে ঐ রচনার সামগ্রিক প্রকৃতির সঙ্গে সুনিবিড় ঐক্যে গ্রথিত হতে হবে। নির্দিষ্ট সাহিত্যিক প্রজাতির জন্য বিষয় নির্বাচন, চরিত্রায়ন, আঙ্গিক, প্রকাশ ভঙ্গি, ছন্দো মাত্রা, রচনা শৈলী ও রচনার মূলগত সুর-সব কিছুকেই বাঞ্চিত ঐক্য সৃষ্টির সহায়ক হতে হবে। কবিকে অবশ্যই খেয়াল রাখতে হবে যেন একই রচনায় ভিন্ন প্রকৃতির বিষয়ের সংমিশ্রণ না ঘটে।’ অৎং ঢ়ড়বঃরপধ সমালোচনামূলক গ্রন্থ হয়েও অত্যন্ত সুখপাঠ্য রচনা বলে স্বীকৃতি পেয়েছে। কারণ সমালোচক হোরেস এর সঙ্গে কবি হোরেস এর সহাবস্থান ঘটেছিল। হোরেসের সমালোচনা ভঙ্গির প্রশংসা করে ইংরেজ কবি পোপ বলেছিলেন;


হোরেস এর অৎং ঢ়ড়বঃরপধ তে অ্যারিস্টটলীয় শিল্প সূত্রের অপরূপ সুন্দর কাব্যিক প্রকাশ ভঙ্গির প্রতিচ্ছবি ল্য করা যায়। হেলেনিক যুগে যখন নাটক ও মহাকাব্য কিছুটা ¤্রয়িমান হয়ে পড়েছিল, সে সময় নীতি কবিতা, শোকগাথা, রাখালী গীতির পাশাপাশি ভাষাতত্ত্ব ও সমালোচনা সাহিত্যের প্রভাব বিস্তারিত হতে থাকে। হোরেস অধিক আলোচনায় না গিয়ে তরুণ কবিদের জন্য প্রায় ত্রিশটি শিল্প সূত্র গ্রথিত করে যান, যা পরবর্তীতে মহামূল্যবান উপদেশ হিসাবে গ্রথিত হয়।

সমালোচক কুইন্টিলিয়ান হোরেস এর কাব্য পত্র ঊঢ়রংঃঁ নামে চিহ্নিত করেন। সমালোচনা সাহিত্যের েেত্র অ্যারিস্টটলের কাব্য নির্মাণ কলার পরেই হোরেস এর  এর স্থান। যদিও সময়ের ব্যবধান প্রায় দু’শত বছর। ল্যাটিন সমালোচনা সাহিত্যিক হোরেস এর প্রভাব ক্রমাগত বৃদ্ধি পেতে থাকে। সনেটের জন§দাতা ইটালীর পেত্রার্ক হোরেস সাহিত্যে ব্যাপকভাবে সম্পৃক্ত ছিলেন এবং বেশ কিছুটা প্রভাবিতও হয়েছিলেন। হোরেস এর সাহিত্যের প্রভাব ইটালীর বাইরে ফ্রান্স, তারপর জার্মানী,পর্যায়ক্রমে স্পেন ও হল্যান্ডসহ বহুদেশে ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে। হোরেস ছিলেন বাক শিল্পী। শিল্পকে কীভাবে মানুষের মর্মমূলে পৌঁছে দিতে হবে তা তিনি খুব ভালভাবেই জানতেন। এবং এজন্যও তার সমালোচনা সাহিত্যের প্রভাব এত দ্রুত বিস্তারিত হতে থাকে।

কিংবদন্তী কবি দান্তেও হোরেস সাহিত্যের একজন অনুরাগী ছিলেন। ইটালীর ভিদা, সিপিওনি পনজা, বার্জিয়ানেল্লী, গ্রেভিনা, ভলপি, আলগেরোট্টি, ভ্যান্নেট্টি, লেপার্ডি, রোবার টেলি, স্কেলিগার; ফ্রান্সের গ্রাঁদিচা, পেলিতিয়ের, মদোঁ, ডেসিয়ার, সানাদোঁ, বইলু, কর্নেইল, রাসিন, মলিয়ের, ভলতেয়ার, রুশো, জাঁ ব্যাপতিস্ত, আঁদ্রে সেনিয়া; জার্মানির অপিৎজ, হাইনস, প্লাতেন, লেসিং, হার্ডার, উইংকেল ম্যান, গ্যেটে, নীটসে; স্পেনের লুইডি জ্যাপাটা, ফ্রান্সিস্কো ডি ক্যাসকালেস, এসপিনেল, জ্যাভিয়ের ডি বার্গোস, মেনেন্ডেজ ওয়াই পিলেও; হল্যান্ডের ডেনিয়েল, হেইনসিয়াস, ডি অ্যালাম বার্ট; ইংল্যান্ডের বেন জনসন, ওয়ার্ডসওয়ার্থ, ড্রাইডেন, টেম্পল, রোজার অ্যাসচাম, স্যামুয়েল জনসন, চ্যাপম্যান, রসকোমন, এডিসন, ফিল্ডিং, স্মোলেট, গ্রে, কোলরিজ; যুক্তরাষ্ট্রের হোলমস, লোয়েল, স্টেডম্যান, ব্যাবিট, মোর, জন শাওয়ারম্যানসহ পৃথিবীর বহু দেশের বহু পন্ডিত, সমালোচক, সাহিত্যিক হোরেস এর দ্বারা প্রভাবিত ছিলেন এবং এদের প্রত্যেকেই হোরেস এর সমালোচনা সাহিত্যের গুরুত্ব উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন। সমালোচকদের ভাষায় বলা যায়,


বিভিন্ন দেশের বিভিন্ন ভাষার ওপর যেমন হোরেস এর প্রভাব রয়েছে, তেমনি বাংলা সাহিত্যের ওপরও হোরেস এর ব্যাপক প্রভাব ল্য যোগ্য। মাইকেল মধুসূদন দত্ত, রাজেন্দ্রলাল মিত্র, বঙ্কিম চন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের কাসিক্যাল লেখাগুলিতে হোরেস এর প্রভাব রয়েছে। মধুসূদন এর মহাকাব্যে ট্রাজিক চরিত্র নির্মাণে, রাজেন্দ্রলালের বিবিধার্থ সংগ্রহ পত্রে এবং বঙ্কিমের বাঙ্গালার  নব্য লেখকদের প্রতি নিবেদন শীর্ষক প্রবন্ধে হোরেস এর উপদেশ বাণী ও শিল্প সংগত রূপের স্বার স্পষ্ট। বঙ্কিমের যে সব উপদেশের সাথে হোরেস এর এর স্পষ্ট প্রতিধ্বনি রয়েছে, সেগুলির কয়েকটি এ রকম ঃ

১. যদি মনে এমন বুঝিতে পারেন যে লিখিয়া দেশের বা মনুষ্য জাতির কিছু মঙ্গল সাধন করিতে পারেন, অথবা সৌন্দর্য সৃষ্টি করিতে পারেন, তবে অবশ্য লিখিবেন।
২. যাহা লিখিবেন তাহা হঠাৎ ছাপাইবেন না। কিছুকাল ফেলিয়া রাখিবেন। কিছু কাল পরে উহার সংশোধন করিবেন। তাহা হইলে দেখিবেন প্রবন্ধে অনেক দোষ আছে। কাব্য-নাটক-উপন্যাস দুই এক বৎসর সংশোধন করিলে বিশেষ উৎকর্ষ লাভ করে।
৩. যে বিষয়ে যাহার অধিকার নাই, সে  বিষয়ে তাহার হস্তপে অকর্তব্য।

আধুনিক বাংলা সাহিত্যের মতো বাংলা সমালোচনা-সাহিত্যেরও সূত্রপাত ঘটেছে ঊনবিংশ শতাব্দীতে। পাশ্চাত্য শিা দীার সূত্রে ঐ শতাব্দীতে বাংলা সাহিত্যে সমালোচনার আবির্ভাব ঘটে। বঙ্কিমের প্রবন্ধ ছাড়াও পূর্ণচন্দ্র বসুর ‘সাহিত্যে খুন’ প্রবন্ধে হোরেস এর সমালোচনার প্রত্য প্রমাণ রয়েছে। বাংলা সাহিত্যে হোরেস এর প্রভাব সম্পর্কে এখনও বিশেষভাবে গবেষণা হয়নি। তবে বাংলা সমালোচনা-সাহিত্যের ইতিহাস রচয়িতাগণ এ বিষয়ে নজর দেবেন বলে আশা করা যায়। সাহিত্যের আধুনিক বিচিত্র জটিল বিকাশ সত্ত্বেও হোরেস সমালোচনা-সাহিত্যের প্রভাব অন্তঃ সলিলা ফল্গুধারার মতো অল্েয আজও বহমান, তা অনস্বীকার্য। সাহিত্যকে সুন্দরভাবে, সাবলীলভাবে, শৈল্পিকভাবে উপস্থাপন করতে হলে হোরেস এর সমালোচনা সাহিত্য সম্পর্কে জানতে হবে, তবেই  যথেষ্ট সার্থকতা সম্ভব।

ল্যাটিন সাহিত্যের ‘আঁধার ঘরের মানিক’ হোরেস এর বন্ধু ও পৃষ্ঠপোষক মেসিনাসের স্বল্পকাল পরেই খ্রিস্টপূর্ব ৮ অব্দে ধরাধাম থেকে বিদায় নেন। মৃত্যুর বেশ কয়েক বছর আগে বন্ধুকে উদ্দেশ্য করে লিখেছিলেন,


কবির সে বাণী অরে অক্ষরে সত্য বলে প্রমানিত হয়েছিল। মৃত্যুর পর বন্ধুর পাশেই এসকুইলিন পাহাড়ে তাকে সমাহিত করা হয়েছিল। পাহাড়ের যে অংশটি কেটে সমতল করে উদ্যান বাটিকায় পরিণত করা হয়েছিল, সে বাগানেই তিনি অনন্ত শয্যায় শায়িত আছেন। কৃতজ্ঞ ভরা চিত্তে আজও আমরা তাকে শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করি।

তথ্য সূত্র ঃ
ক্স হোরেস এর কাব্যতত্ত্বÑসুনীল কুমার মুখোপাধ্যায়
ক্স হোরেস এর আর্স পোয়েটিকা (কাব্যকলাতত্ত্ব)Ñসাধন কুমার ভট্টাচার্য
ক্স সমালোচনার কথাÑশ্রী অসিত কুমার বন্দ্যোপাধ্যায়
ক্স সাহিত্যঃ সুরেশ চন্দ্র সমাজপতি সম্পাদিত
ক্স সাহিত্য সন্দর্শনÑশ্রীশ চন্দ্র দাশ


কোন মন্তব্য নেই

Blogger দ্বারা পরিচালিত.